সত্যজিতের ঘরবাড়ি

লম্বা চওড়া ইজি চেয়ার। তার পিছনেই জানলা। বাইরে তাকালে বাড়ির সীমানা। তার পার ঘেঁষে গাছ গাছালির ঝাড়। রাস্তার পাশেই বাড়ি, কিন্তু একটা শব্দও স্পর্শ করতে পারে না সেই জানলাকে।

অন্দরের বারান্দায় এমনি এমনি ফুল ঝরে পড়ে। তারের জাল জড়িয়ে ঝাঁটি ফুল, দোপাটি।
আবছায়া ঘর। গরাদ ডিঙিয়ে আলো এসে পড়েছে কেদারার গায়ে।
সেই আলোর মাঝে এক দীর্ঘদেহী মানুষ। নিমগ্ন খাতায়।

বাড়ির ঠিকানা ৮ নম্বর বিশপ লেফ্রয় রোড। গোটা পৃথিবীর সিনেমা প্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে এই ঘরখানা। যেন এক আশ্চর্য মেধার কারখানা। যেখানে সারাক্ষণ জন্ম নিচ্ছে বিস্ময়।

ব্রিটিশ আমলের পেল্লায় বাড়ি। সদর থেকে কার্পেট মোড়া সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়। তার পাশেই সাবেক আমলের লিফট। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁ দিকের ফ্ল্যাট। নম্বর ৮।

আগে কলিংবেল বাজালেই দরজা খুলতেন এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। নাম সত্যজিৎ রায়।
ভিতরে পা রাখলেই প্রথমেই চোখ যায় সুকুমার রায়ের প্রতিকৃতিতে। ঠিক পাশটিতেই রাখা সুপ্রভা রায়ের নিজের হাতে গড়া মূর্তি।
তারপরেই সেই বিখ্যাত স্টাডিরুম। মানিক রাজার সাম্রাজ্য।

ছবির কাজ না থাকলেই ঘরেই কেটে যেত সকাল থেকে সন্ধে। দিন থেকে রাত। বই আর পুরনো ম্যাগাজিনে ভরা আলমারী এখনও অবিকল। যেমন পিয়ানোটা।

প্রথমে ১০০ নম্বর গড়পার রোড। তারপর ভবানীপুর বকুল বাগান। সেখান থেকে রাসবিহারী এভিনিউ। লেক টেম্পল রোড। লেক প্লেস হয়ে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি।

সত্যজিতের জীবনে বাসা বদল হয়েছে একাধিক বার। কিন্তু একেবারে নিজস্ব বাড়ি কোনদিন ছিল না।
তাঁর জন্ম ১০০ নম্বর গড়পারের বাড়িতে। এ তাঁর পৈতৃক বাড়ি।
বাড়িটি তৈরি করেছিলেন পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।

BishopLefroyRd1

তিনি নিজে নকশা করে এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। তার মাত্র তিন বছর পরে ১৯১৫ সালে তিনি এই বাড়িতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

গড়পার রোডের বাড়িটার সামনের অংশে ছিল ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়।

একতলায় অফিস ও ছাপাখানা আর দোতলায় স্টুডিও ও ব্লক তৈরির ব্যবস্থা। উত্তরমুখী হলঘরের বড় বড় কাচের জানালা।
বাইরের দেয়ালে সুন্দর পদ্ম-ফুলের নকশা ছিল। তার উপরে ইংরেজি হরফে সংস্থার নাম লেখা।
বাবার মৃত্যুর পর সেই বাড়ি ছেড়ে মা সুপ্রভা শিশু মানিককে নিয়ে দাদার বাড়ি বকুলবাগান চলে আসেন।
সেখান থেকে রাসবিহারী এভিনিউয়ে।

১৯৫৯ পর্যন্ত রায় পরিবারের ঠিকানা ছিল দক্ষিণ কলকাতার ৩১, লেক এভিনিউ।
এর পর ৩, লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে যান তাঁরা। সব শেষ ঠিকানা হয় ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে।

লেক এভিনিউ এর বাড়িতে থাকতে থাকতেই আরম্ভ হয়েছিল অপুর সংসারের শুটিং।
মূলত মা সুপ্রভা দেবীর কারণেই অন্য বাড়ির খোঁজ শুরু হয়। রীতিমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বাড়ি দেখা শুরু করেন সত্যজিৎজায়া বিজয়া রায়।

তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট চাই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেলে পছন্দের বাসা। লেক টেম্পল রোডে। বেশ বড় বড় ঘর। তিন বেডরুম। স্টাডি। অফিস। ছাদ। তিনতলার বাড়ির ওপরের তলাটা রায় পরিবারের।

প্রথম প্রথম খুব পছন্দ হল বাড়ি। কিন্তু একমাস কাটতে না কাটতেই ফের বাড়ি বদলের ভাবনা। শুরুর দিকে বাড়ি ভাল লেগেছিল, কারণ তখনও গরম পড়েনি।

তিনতলার ওপর ঘর। নতুন বাড়ি। পাতলা দেওয়াল। পরিত্রাহী গরম।
আবার বাড়ির খোঁজ। দশ বছর ধরে চেষ্টার পর মিলল মনের মতো ঠিকানা। ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...