'‘মাটির কলস ছাড়া পিপাসা জানি না”
১৮৮০ সালে হায়দ্রাবাদে আজকের দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবি বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছিলেন দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, দেশভাগ, পার্টিভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন, বন্দিমুক্তি আন্দোলন, জরুরী অবস্থার মধ্যে দিয়ে। দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধার দেশে ভোগবাদী সমাজ জীবনের বিরূদ্ধে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তীব্র ধিক্কার। ন্যায় ও সততাকে সঙ্গী করে আজীবন বেঁচে ছিল তাঁর দৃঢ় প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।
ছেলেবেলায় বিনি নামেই পরিচিত ছিলেন, তৎকালীন হায়দ্রাবাদ ছিল ব্রিটিশ শাসিত। মাদ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পর্বের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পর্যায়ের পাঠ সম্পন্ন করেন বীরেন। তেলেগু, বাংলা, তামিল, উর্দু, পারসি, হিন্দি’র মত ভারতীয় ভাষা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এই কবি। পরে ফরাসি, জর্মান, ইতালিয়ান, ডাচ, রুশ এবং স্ক্যান্ডিনিভিয়ান ভাষাও দক্ষতার সাথে করায়ত্ত করেন।
বাংলায় প্রচলিত কবিতার সম্পূর্ণ বিপরীত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণার ভাষাই ছিল তাঁর কবিতার প্রধান বারুদ। “মুখে যদি রক্ত ওঠে/সে কথা বলা এখন পাপ”, শুধু এই একটি বাক্যই প্রমাণ করে আজকের দিনে দাঁড়িয়েও তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক। বিপ্লবী চেতনার পাশাপাশি প্রেমও ছিল তাঁর কবিতার অন্যতম ক্ষেত্রপরিসর। আর সত্যি বলতে প্রেম ছাড়া প্রতিবাদ স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের প্রতি অগাধ প্রেমের কথা বারবার উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়, “যেখানে আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাতের আকাশে/ কারা যেন আজও ভাত রাঁধে/ভাত বাড়ে ভাত খায়/আর আমরা সারারাত জেগে থাকি/আশ্চর্য ভাতের গন্ধে/ প্রার্থনায় সারারাত”
ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ব্রিটিশরাজ উৎখাত করার ক্ষেত্রে সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বীরেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জোট বেঁধেছিলেন জর্মানির সাথে, ছিলেন জর্মানের কমিউনিস্ট পার্টি ও বার্লিন কমিটির অন্যতম গুরূত্বপূর্ণ সদস্য। আর তার সুবাদেই ইওরোপে ভারতীয় ছাত্রদের সংগঠিত করে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার গুপ্ত বীজমন্ত্র। ১৯৩০ সালে বেশ কিছু বছর মস্কোয় কাটান তিনি। বিপ্লবী ও গেরিলা কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে থাকার দরুণ ১৯৩৭-এ জোসেফ স্তালিনের গ্রেট পার্জ-এ গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে।
১৯৬৮-৬৯ এ নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁর বেশ কিছু কবিতায় সুরারোপ করে বেঁধেছিলেন মানুষের গান। প্রতুলবাবুর প্রথম ক্যাসেট ‘পাথরে পাথরে আগুন নাচে’ মূলত ছিল তাঁর গান নিয়েই। অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে বহু কবি-শিল্পী শরিক হয়েছিলেন তাঁর মরমী চেতনার বাহুবন্ধনে।
১৯৪৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘গ্রহচ্যুত’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের নামকরণের সাথে তাঁর ব্যক্তিজীবনের অপরিবর্তনীয় সামঞ্জস্য লক্ষ্য করার বিষয়। তথাকথিত কবিদের ভিড়ে তিনি ছিলেন এক গ্রহচ্যুত মানুষ, আউটসাইডার। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘সত্য ভেঙ্গে গেলে’, ‘মহাদেবের দুয়ার’, ‘হাওয়া দেয়’, ‘মুন্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে’, ‘রাস্তায় যে হেঁটে যায়’, ‘মানুষখেকো বাঘেরা বড় লাফায়’, ‘বাহবা সময় তোর সার্কাসের খেলা’, ‘পৃথিবী ঘুরছে’ ছাড়াও আরও বিভিন্ন পুস্তিকা ও বুলেটিনে তাঁর কবিতাগুলি প্রকাশিত হয়েছে। যশ, খ্যাতি, প্রাচুর্যের থেকে অনেক দূড়ে একা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাজ্ঞ মানুষ, আজীবন বলে গেছেন মানুষের কথা, আদর্শ ও বিশ্বাসকে বজ্রচেতনায় ধারণ করে লিখে গেছেন অনাবিল ‘কালো বস্তির পাঁচালী’।
“অস্থির হয়ো না;
শুধু, প্রস্তুত হও।
এখন কান আর চোখ
খোলা রেখে
অনেক কিছু দেখে যাওয়ার সময়।
এ সময় স্থির থাকতে না পারার
মানেই হল, আগুনে ঝাঁপ দেওয়া
তোমার কাজ
আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয় –
আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা
অস্থির হয়ো না;
শুধু, প্রস্তুত হও।“
সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে মানুষকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে রাখার প্রাচীন প্রক্রিয়া এখনও জাগ্রুক, সেখানে বীরেন্দ্রনাথ পাঠ ভীষনভাবে প্রয়োজনীয় বলে বোধ হয়। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত মনীষাদীপ্ত চাবুককন্ঠ পাঠক মননে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম। কখনই তিনি প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা করেননি, বরং প্রাতিষ্ঠানিক ভাঁড়ামোর উপর এখনও কলার তুলে দৃঢ়চেতা দাঁড়িয়ে আছেন কবি বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।