ওপর থেকে দেখে মনে হবে নিরেট ধাতু দিয়ে গড়া একটি ধ্যানরত বৌদ্ধ মূর্তি| কিন্তু কানাঘুষো শোনা যেত ছিল নেদারল্যান্ডসেরই একটি মিউজিয়ামে থাকা বৌদ্ধ মূর্তির মধ্যে একটি মানবদেহ আছে | বিজ্ঞানীদের কাছেও সঠিক তথ্য জানতেন না| আর এই রহস্য উদঘাটন করতে সম্প্রতি ওই মূর্তিটির স্ক্যান করাতে নিয়ে যাওয়া হয় একটি হাসপাতালে| নেদারল্যান্ডসের দ্য মিয়েন্ডার মেডিক্যাল সেন্টারে সিটি স্ক্যান করানো হয় হাজার বছরের এই প্রবীণ ‘রোগীকে’|
বৌদ্ধ মূর্তির স্ক্যান করানোর পর অবাক হন ডাক্তাররাও| সোনালী রঙের ওই ধাতুর মূর্তির ভিতরে রয়েছেন এক সন্ন্যাসী| পদ্মাসনে ধ্যানে বসে আছেন ওই সন্ন্যাসী| তবে মমি আকারে মূর্তির মধ্যে থেকে ওই সন্ন্যাসীর দেহে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাওয়া যায়নি| শুধু মাত্র দেহের কাঠামোটুকুই রয়ে গেছে, তারমধ্যে পুরে দেওয়া হয়েছিল বৌদ্ধ ভাষায় লেখা কাপড়| মিশর ছাড়াও চীন ও জাপানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নিজেদের দেহকে মমিতে পরিনত করা প্রচলিত প্রথা| কী ভাবে এই সন্ন্যাসীর দেহ থেকে সমস্ত অঙ্গ বার করে নেওয়া হল, কী ভাবে তাঁর মমি তৈরি হল তা এখন অধরা রয়ে গেছে বিজ্ঞানীদের কাছে|
জেরেমিয়া কেন নামে এক লেখক তাঁর লিভিং বুদ্ধা শীর্ষক এক বইয়ে লিখে গেছেন, কঠিন এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে জীবন্ত অবস্থাতেই মমি হওয়ার পথে অগ্রসর হতেন| তাঁরা শর্করা ও প্রোটিন জাতীয় কোনো খাদ্য যেমন চাল, গম, সোয়াবিন জাতীয় খাবার গ্রহণ করতেন না | শুকনো গাছের ছাল খেতেন। এতে নাকি ক্রমে তাঁদের শরীরের চর্বি গলে যেত এবং শরীর আর্দ্রতা হারিয়ে ক্রমশ শুষ্ক হয়ে উঠত। মৃত্যুর পর শরীরে ব্যাকটিরিয়ার বৃদ্ধি আটকাতে বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ খেতেন ব্যবহার করতেন । আর খেতেন বিষাক্ত জড়িবুটি দিয়ে বানানো বিশেষ এক ধরনের চা। এই চা পান করার ফলে তাঁদের শরীরও বিষাক্ত হয়ে যেত| সেভাবে কোনো খাদ্য না খাওয়ায় ক্রমেই সন্ন্যাসীর শরীর অবসন্ন ও নিস্তেজ হয়ে পড়ত| এরপর তাঁকে মাটির নিচে একটু ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে আসা হত| একটি বাঁশের নলের মাধ্যমে তিনি শ্বাস নিতেন| কক্ষের ভিতরেই ধ্যানে বসতেন তিনি সন্ন্যাসীর সঙ্গে শুধু একটা ঘণ্টা দেওয়া হত | ওই ঘন্টা বাজিয়ে তিনি প্রতিদিন প্রতিদিন জানান দিতেন যে তিনি জীবিত| যেদিন মারা যেতেন তার পর থেকে তিন বছর পর তাঁকে কক্ষ থেকে বার করে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হত| তবে
এইভাবে দীর্ঘদিন ধরে কৃচ্ছসাধনের ফলে ওই সন্ন্যাসী যখন একেবারেই মৃতপ্রায়, তখন তাঁকে মাটির নীচে একটি কক্ষে স্থানান্তর করা হত। তিনি সেই কক্ষের ভিতরেই ধ্যানে বসতেন। আর বাঁশের তৈরি একটি ফানেলের মধ্যে দিয়ে শ্বাস নিতেন।ওই কক্ষে সন্ন্যাসীর সঙ্গে শুধু একটা ঘণ্টা থাকত। প্রতিদিন তিনি ঘণ্টা বাজিয়ে বোঝাতেন যে, তিনি বেঁচে আছেন। যে দিন তিনি ঘণ্টা আর বাজাবেন না, সে দিনই ধরে নেওয়া হত তিনি মারা গিয়েছেন। তার পর বাঁশের ফানেলটা খুলে নেওয়া হত। এই ভাবেই তিনি মাটির নীচে ওই কক্ষে পড়ে থাকতেন। তিন বছর পর অন্য সন্ন্যাসীরা তাঁকে কক্ষ থেকে বার করে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেন। কোনও সন্ন্যাসীর যদি মমিফিকেশন না হয়ে থাকে, তা হলে তাঁকে কবর দেওয়া হত।
তবে বৌদ্ধ মূর্তির মধ্যে সন্ন্যাসীর মমির খোঁজ এই প্রথমবার মিলল বলে জানাচ্ছেন ইতিহাসবিদেরা। হাঙ্গেরির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে তারপর ইউরোপের লুক্সেমবার্গ মিউজিয়াম ঘুরে শেষে নেদারল্যান্ডসের ড্রেন্টস মিউজিয়ামই ঠিকানা হয়েছিল এই মূর্তির|