মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছেন। তিনি জানেন যে অসুখ তাঁর হয়েছে তার তেমন কোনও চিকিৎসা নেই। মনসূয়া গ্রামে গিয়েছিলেন জমিদারির কাজে। ফিরলেন জ্বর বাঁধিয়ে। যেমন তেমন নয়- একেবারে কালান্তক কালাজ্বর।
একটু একটু করে বিছানা শয্যায়। বয়স মাত্র ছত্রিশ। রোগের যন্ত্রণা কম নয়। তবু শান্ত সুকুমার। বাবা উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি উপন্যাস থেকে ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘তাতা’।
১৯২১-এ কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে টানা দু-আড়াই বছর রোগ ভোগ। বিছানাবন্দী জীবনে নড়াচড়ার উপায় ছিল না। সচল শুধু কলমখানি। রসের ধারায় সদা টইটম্বুর রাখতেন সেটিকে। অসুখের দিনগুলোতেও ছাপা, লেখা নিয়ে ভাবনা থেমে নেই। শারীরিক কষ্টের কাছে নতি স্বীকার করেন নি। অসুখের কাছে ধরা দেয়নি তাঁর মন। শান্ত মনে মেনে নিয়েছিলেন বাস্তব।
মুদ্রণ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত গিয়েছিলেন। বাবা উপেন্দ্রকিশোর তখন পরিকল্পনা করছেন ছোটদের জন্য নতুন পত্রিকার। ১৯১৩ সালে বিলেত থেকে ফিরেই উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। একেবারে নতুন এক অভিনবত্ব দেখা গেল লেখায়। বাংলায় ‘ননসেন্স ভার্স’।
তাঁর ভাইবোন, রায়চৌধুরি বাড়ির ছোটদের কাছে সুকুমার ছিলেন আনন্দের জোগানদার। ছোটদের জন্য লেখা ননসেন্স ছড়াও হল তেমন মজার। কল্পনা আর ছন্দের আনন্দে অদ্ভুত রস। যেম ন লেখা তেমন ছবি।
রোগশয্যায় নিরন্তর কাজ করে গেলেন ছড়া আর ছবি নিয়ে বইয়ের জন্য। রোগ যখন তার দাঁত নখন আরও শানিয়ে থাবা বসিয়েছে শরীরে তখন তাঁর হাতে এল বইয়ের মলাট আর ডেমো কপি।
১০ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন। প্রয়াণের ঠিক ন’ দিন পর প্রকাশ পেল প্রয়াত কবির প্রথম বই ‘আবোলতাবোল’।
কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর সম্পর্কে সিগনেট প্রকাশনের কর্ণধার দিলীপকুমার গুপ্তকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,
প্রথম যৌবনে যে সব কবি ও সাহিত্যিকদের লেখা আমার ভালো লাগত, তাঁদের অনেকেরই রচনা সম্পর্কে আগেকার সেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সুলুমার রায়ের লেখা- প্রধানত তাঁর কবিতা— বিশেষ করে তাঁর ‘আবোল তাবোল’ বইটি সম্বন্ধে আমার এবং আশা করি প্রায় সকলেরই আগ্রহ এখনও প্রচুর। বইখানি বিশেষ কোনও সময়ে সৃষ্টি হয়েও সময়োত্তীর্ণ বিশেষত্বে প্রদীপ্ত।’’
বইয়ের সূচনায় সুকুমার লিখেছিলেন, “যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং, সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারিবেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।”
অবিশ্বাস্য সব মজা, রংদার কান্ডকারখানা, যা ইচ্ছে তাই-এর আনন্দ তিনি মিশিয়েছিলেন ‘আবোলতাবোল’। বাঁধন ছেঁড়া মুক্তির আনন্দ আছে তাতে। সেই রস শিশুর সারল্যের মতো অবাধ, মুক্ত। বড়দের দুনিয়ায়র যুক্তি তক্কের গন্ডিতে মাপা যায় না। সেই জন্য সুকুমার নিজেই মুখবন্ধের শিরোনাম করেছিলেন ‘কৈফিয়ত’।
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়
আয়রে পাগল আবোল তাবোল মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়
সুকুমারের প্রয়াণ দিবস শততম বর্ষ স্পর্শ করল এই ২০২৩-এ। আবোলতাবোলের বয়স হল ১০০। ১০০ বছর ধরে বাঙালির সঙ্গী এই বই। বাঙালি শিশুর বয়স বাড়ে, তারা বৃদ্ধ হয়, বয়স বাড়ে না ‘আবোলতাবোল’র