সারা পৃথিবীর বইপ্রেমীদের কাছে তীর্থস্থান এই বইয়ের দোকান

প্যারিসের নোদরদাম গির্জা থেকে এক মিনিটের হাঁটা পথ। স্যান নদীর তীরে একটি পুরনো দোকানে, হলুদ সাইনবোর্ডের ওপর লেখা ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী’।  তিনটি সাইনবোর্ড― দুটি বোর্ডে লেখা ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী’। অপর সাইনবোর্ডে লেখা ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী ক্যাফে’।

শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী সারা পৃথিবীর বইপ্রেমি মানুষের কাছে তীর্থস্থানের মতো।

sheakes-3

বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রাচীন বইয়ের দোকানগুলির মধ্যে অন্যতম। ‘কিলোমিটার জিরো’ প্যারিস শহরের কেন্দ্রবিন্দু।  

মার্কিন লেখিকা মাদার অব লিটারেচার সিলভিয়া বিচ হুইটম্যান  ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী’। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে।

sheaks

‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী’কে শুধুমাত্র ‘বইয়ের দোকান’ হিসেবে গড়ে তোলেননি সিলভিয়া, চেয়েছিলেন বৌদ্ধিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে। মানুষের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস ছড়িয়ে পড়ুক। আর্থিক কারণে তাতে যেন ছেদ না পড়ে। বইয়ের টানে ক্রমশ বাড়তে লাগল তরুণ লেখক-লেখিকাদের ভিড়।

শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং নিয়ে বহু কাহিনী শোনা যায় পৃথিবী বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মুখে।

 এজরা পাউন্ড, জেমস জয়েস, হেনরি মিলার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিনক্লেয়ার লুইসের মতো মানুষরা আসতেন এই দোকানে আড্ডা দিতে। ধারে বই আর বিনামূল্যের কফি যদি এক আকর্ষণ হয় তবে অন্য আকর্ষণ অবশ্যই আড্ডা। হেনরি মিলার একে বলেছেন ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড অব বুকস’।  এই বুকস্টোরের গ্লপের ঝুলিতে নামী লেখকদের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে নবীন লেখকদের কথা। নানাভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং।

জেমস জয়েস তখন পেশায় কেরানী। নিজের সাহিত্য জীবনকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য তুলুম সংগ্রাম চালচ্ছেন। তাঁর জন্য ইউলিসিস উপ্ন্যাসের জন্য কোনও প্রকাশক পাচ্ছিলেন না। এগিয়ে আসেন সিলভিয়া। নিজের ব্যয়ে তিনি ইউলিসিস প্রকাশ করেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সিলভিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এই বুক স্টোরকে কেন্দ্র করেই লিখেছিলেন, ‘অ্যা মুভেবল ফিস্ট’।

shea

কিন্তু একটা সময় 'শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী' বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সিলভিয়া। ১৯৪১ সালে বিশ্ব জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা প্রভাব ফেলেছিল এই বইঘরটিতেও।  জার্মানরা প্যারিস দখল করলে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী’ বন্ধ করে দিতে হয়। মিত্রবাহিনী প্যারিস মুক্ত করলে আবার শুরু হয় শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী। অবশ্য বদলে যায় দোকানের  ঠিকানা হয় আজকের কিলোমিটার জিরো।

১৯৫১ সালে আবার নতুন করে শুরু হয় শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোম্পানী’র যাত্রা। তবে সিল্ভিয়া নয়, এক সেনা কর্তার হাত ধরে। তাঁর নাম জর্জ হুইটম্যান।

sheakes-1

এক সময় জর্জ  বদলে দিয়েছিলেন ঐতিহ্যবাহী বুক স্টোরের নাম। নতুন নাম রাখা  ‘ লে মিস্ট্রাল'

১৯৬৪ সালে সিলভিয়া বিচের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আবার ফিরিয়ে আনা হয় পুরনো নাম। সেই বছরের আবার শেক্সপিয়রের ৪০০ তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়।  

শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং- এ আছে লেখকদের জন্য হোটেলে। বইয়ের দোকান নিচে। দোতলায় বিশ্বের যে কোনও দেশের লেখক এসে বিনামূল্যে রাত্রিবাস করতে পারবেন।

sheakes-4

দোকান যতক্ষণ খোলা ততক্ষণ পাঠকরা এখানে বসে পড়তে পারেন। তবে বই বাড়িতে আনার নিয়ম নেই। একশো বছর ধরে চলে আসছে এই নিয়ম।

বুক স্টোর ঘিরে জর্জের পাগলামির অন্ত ছিল না। শেক্সপিয়র অ্যান্ড কোং যেমন তার নিজস্ব চরিত্রের জন্য বিখ্যাত ছিল তেমনই জর্জও বিখ্যাত ছিলেন তাঁর মেজাজের জন্য। পাঠকদের জন্য অলিখিত নিয়ম ছিল একদিনে একটা বই পড়তে হবে।  বুকস্টোরকে তিনি বলতেন, ‘তিন শব্দে লেখা একটা উপন্যাস।’  

sheakes-2

জর্জ লিখেছেন, ‘মানুষ যেমন উপন্যাস লেখে তেমনি আমি এই বুকস্টোর সৃষ্টি করেছি। প্রতিটি কক্ষ একটি অধ্যায়ের মতো করে সাজিয়েছি। আমি চাই বই যেমন মানুষকে তাদের কল্পনার পৃথিবীতে নিয়ে যায় তেমনি বই খোলার মত করে মানুষ এর দরজা খুলুক।’

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...