ছবি যেদিন থেকে চলতে শুরু করে সেদিন হলো চলচ্চিত্রের জন্মদিন-সেদিন ছিল ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর।প্যারিসের গ্র্যান্ড কাফেতে প্রায় কুড়িটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি দেখানো হয়।প্রথম চলচ্চিত্র তৈরি ও দেখানোর কৃতিত্ব ফরাসি দুই ভাইয়ের-অগাস্ট এবং লুই লুমিয়ের , যাঁরা পরে লুমিয়ের ব্রাদার্স নামে বিখ্যাত হন।১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই ফরাসি লুমিয়ের ভাইদের কর্মচারী ম্যরিস সেসটিয়ার মুম্বাই-এর ওয়াটসন হোটেলে চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করেন।প্রদর্শনীটির নাম রাখা হয়েছিল 'সিনেমাটোগ্রাফি'। সেই থেকেই ভারতবর্ষের মাটিতে নির্বাক চলচ্চিত্রের সূচনা ঘটল।ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় সিনেমাগুলি প্রদর্শিত হয়।তারপর ব্যবসায়িক বুদ্ধিসম্পন্ন ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে এখানকার থিয়েটার মালিকদের একটা বোঝাপড়া ঘটে।থিয়েটার দেখানোর আগে বা পরে এরকম ছোটো ছোটো স্বল্পদৈর্ঘ্যের বায়োস্কোপ বানানো হত। প্রথম দিকে বিদেশি কোম্পানির হাত ধরে এভাবেই বাংলায় এল বায়োস্কোপ। বাঙালি সবচেয়ে সংস্কৃতিমনস্ক জাতি।সিনেমার এই জন্মলগ্নে বাঙালিরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকলো না। শুধু বাংলা নয় , বস্তুত ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসেই প্রকৃত জনকরূপে হীরালাল সেন-এর নামোল্লেখ করা চলে। যদিও সরকারি স্বীকৃতি অনুযায়ী এই সম্মান মারাঠি-ধুন্দিরাজ গোবিন্দরাজ ফালকে -যাঁর নামেই দেশের সর্বোচ্চ সিনেমা পুরস্কার ফালকে সম্মান। ১৯১৭ সালে একটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ফলে হীরালালের সমস্ত কীর্তি(ক্যামেরাবন্দি কাহিনিচিত্র)পুড়ে ছাই হয়ে যায়।সেইসব কীর্তি থাকলে আজ বাংলা সিনেমার ধারা অন্যখাতে বইতে পারত। সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম সার্থক প্রয়াস চন্দ্রমোহন সেন-এর দুই কৃতী পুত্র হীরালাল ও মতিলালের হাত ধরেই সূচিত হয়েছিল তা আজ সিনেমা সমালোচক মাত্রই এ কথা স্বীকার করেন।
হীরালালের বাবা ছিলেন আইন ব্যবসায়ী।ঢাকার অনতিদূরেই মানিকগঞ্জ মহকুমার বগজুরী গ্রামের বাসিন্দা।পরে অবশ্য কলকাতায় চলে আসেন।হীরালাল ও মতিলাল দুই ভাই ছিলেন সিনেমা পাগল।বাবার পেশা তাঁদের মনে ধরেনি।ফাদার লাঁফো এবং স্টিফেন্সের সিনেমা প্রদর্শনী দেখেই হীরালাল সিনেমা বানানোর প্রতি আগ্রহী হন। স্টিফেন্স সাহেবের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর হীরালাল নিজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে লন্ডনের জন রেস অ্যান্ড সন্স কোম্পানির কাছ থেকে সিনেমা- প্রোজেক্টর মেশিন আনেন।অনেক চেষ্টা চরিতের পর ফাদার লাঁফোর সাহায্য নিয়ে 'ইনোসেন অ্যান্ড সিল্ক '|
কোম্পানি থেকে ট্যাংক আনিয়ে বায়োস্কোপ দেখানোর ব্যাপারটায় অনেকটাই এগিয়ে যান তিনি।সময়টা ১৮৯৬-৯৭।ছোটোভাই মতিলালকে নিয়ে হীরালাল গড়লেন 'রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি'।সমগ্র বিশ্বের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম আর্কল্যাম্প প্রোজেক্টরের সাহায্যে গ্রামে-গঞ্জে ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৮ সাল নাগাদ ফ্রান্সের লুমিয়ের ভাতৃদ্বয়ের মতো চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শুরু করেন হীরালাল-মতিলাল।বিদেশি সিনেমার প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়তে শুরু করে ।তবে এটুকুতেই থেমে থাকেনি হীরালালের মন।তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন বিখ্যাত ফরাসী দুই ভাই পাতে ব্রাদার্স।তাঁরা সিনেমার যন্ত্রপাতি বিক্রি এবং ভাড়ার ব্যবসা করতেন।এই দুই ভাই ভারতে এলে তাঁদের সঙ্গে হীরালালের যোগাযোগ হয়। তাঁদের থেকে একটি ক্যামেরা ভাড়া করে হীরালাল নিজেই কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় শুটিং শুরু করেন।তিনি এই সময় বেশ কিছু জনপ্রিয় নাটকের বিশিষ্ট অংশ মঞ্চস্থ অবস্থায় ক্যামেরাবন্দি করেন।শুধু তাই নয় মঞ্চ সফল কিছু নাটক থেকে টুকরো টুকরো ছবি সংগ্রহ করে ছায়াছবিও তৈরি করেন , যার মধ্যে 'আলিবাবা' , 'সরলা' , 'সীতারাম' , 'ভ্রমর','মৃণালিনী' উল্লেখযোগ্য।এছাড়া 'বুদ্ধদেব','হরিরাজ','দুটি প্রান' , 'সোনার স্বপন','মনের মতন' প্রভৃতি নাটকেরও নির্বাচিত অংশের চিত্রায়ন ঘটান।এই পর্বের সময়সীমা ১৯০০ থেকে ১৯০৩ সাল।
হীরালাল প্রথমে তথ্যচিত্র নির্মানের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন, বিজ্ঞাপনর জন্যও কয়েকটি ছবি বানান।১৯০৩ সালে কলকাতা ও দিল্লিতে অনুস্ঠিত করোনেশন দরবার, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন চিত্র ক্যামেরাবন্দি করে চলচ্চিত্রায়িত করেন। এই চিত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের 'রাখিবন্ধন'-এর দৃশ্যও স্থান লাভ করেছিল বলে জানা যায়।
১৯০৫ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে শোভাযাত্রা, ১৯১১ সালে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও সম্রাজ্ঞী মেরির দিল্লি আগমন তাঁর ক্যামেরাবন্দি হয়।
তথ্যচিত্র ও বিজ্ঞাপন চিত্রে হীরালালের উল্লেখযোগ্য কীর্তিগুলি হলো-চিৎপুর রোডের উপর তথ্যচিত্র,ঢাকায় জন্মস্থান বাগজুরির বাড়িতে একটি বিয়ের অনুস্ঠান,বগজুরীর ধলেশ্বরী নদীতে স্নানার্থীদের ছবি, রাজেদ্র মল্লিকের বাড়ির বিয়ের ছবি ও নানান অনুস্ঠানের ছবি,দুলিচাঁদ মল্লিকের বাড়ির বিয়ের অনুস্ঠান,শিবচরন লাহার বাড়ির বিভিন্ন অনুস্ঠান । হীরালালের বিজ্ঞাপনের কাজগুলির মধ্যে -সি কে সেনের জবাকুসুম তেল।যেটি তাঁদের আগরপাড়ার বাগানবাড়িতে নেওয়া হয়েছিল, সার্সাপেরিলা ডব্লিউ মেজর কোম্পানির 'সার্সাপেরিলা'।এটাও সি কে সেনের বাগানবাড়িতে কাহিনির মাধ্যমে চিত্রিত এছাড়া এডওয়র্ডস অ্যান্টিম্যালেরিয়াল স্পেসিফিক।বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং-এর পক্ষ থেকে তাঁদের দমদমের বাড়িতে কাহিনির মাধ্যমে চিত্রিত। হীরালাল কখনও পুর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা তৈরি করেননি বটে, কিন্ত করার যে প্রভূত সম্ভাবনা ছিল।সেই কৌশলও তাঁর জানা ছিল।সেই সময়ে(১৯১২-১৩ নাগাদ ) বহু বায়োস্কোপ কোম্পানি তৈরি হয়ে গিয়েছে।হীরালালের কোম্পানি ক্ষতির মুখে পড়ে।১৯১৩ সাল নাগাদ ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদের জেরে ব্যবসা আলাদা হয়ে যায়।হীরালাল মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেন।চরম অর্থসঙ্কটে পড়ে আংটি, ক্যামেরা সব বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।হীরালাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।তাঁর রায়বাগানের বাড়িতে এক ভয়াবহ আগুন লাগে। আর তাতেই সমস্ত ছবির প্রিন্ট, বহু পুরনো ছবি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সালটা ছিল ১৯১৭।হীরালালের মেয়ে অমিয়বালাদেবীও মারা যান তাতে। মুছে যায় এতদিনের সমস্ত প্রমান।
হীরালাল সেনের হাত ধরে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মানের শুভসূচনা, তবে ১৯১৯ সালে জামসেদজি ম্যাডানের প্রযোজনায় প্রথম বাংলা কাহিনিচিত্র 'বিল্বমঙ্গল' তৈরি হয়।নির্মানে, অভিনয়ে এবং পরিকল্পনায় ছিলেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শোনা যায় ম্যাডানের রুস্তমজী, 'ইলেকট্রনিক বায়োস্কোপ'-এর প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় সিনেমার অনেক টেকনিক্যাল কাজ ও পরামর্শ হীরালালের কাছ থেকে নিয়েছিলেন।১৯১৯ সাল। বাংলা ছবি একশো বছরে পদার্পন করলো।বাংলা সিনেমার ১০০ বছরে আমাদের পক্ষ বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার জনক হীরালাল সেনকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই ।