শীতের কলকাতাঃ কুয়াশার বিরতি থেকে এক চিলতে রোদ

শুভদীপ মিত্র, 

নিউটাউন, কলকাতা

 

 

কুয়াশার বিরতি থেকে একচিলতে রোদ এসে পড়েছে একটা চা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টোটো -র উপর। সেই নরম সোনালী ছটায় চালক দাদা আর তার মেয়ের খুনসুটি দেখে আমার মিডউইক প্রেসার কখন যে স্বস্তিতে পরিণত হয়েছে , খেয়ালই নেই। মা বা ঠাম্মার হাতে বুনে দেওয়া সেই লাল-সাদা উলের সোয়েটারে ছোট্টো মেয়েটিকে কি চমৎকার লাগছে। কোনো শপিংমলের কিডস্ জোন থেকে একটা বাচ্চাদের সোয়েটার কিনতে যত টাকা লাগে , সেটা হয়ত এই টোটো দাদা আর বাড়ি বাড়ি কাজ করা তার স্ত্রীর সাপ্তাহিক উপার্জন। কিন্তু সেই অনটনের সাতকাহন তো শিশুরা বোঝেনা। তাই তাদের প্রাণোচ্ছ্বল হাসির কাছে আমাদের পার্থিব দিনকাল ও উৎকণ্ঠা খাটো মনে হয়।

হয়ত সেই কারনেই একাল ও সেকালের গুরুজনেরা দাম্পত্য কলহ বেড়ে ওঠা নতুন বিবাহিতদের বলেন বা বলতেন " তোরা এবার একটা একটা ভাবনাচিন্তা কর ", আসলে পুরনোপন্থী গুরুজনেরা আশিটা তেতো ও প্রাচীন কথার পরে , দু পাঁচটা দামি কথাও বলে ফেলেন কিনা! তাই।

আমরা বড়রা শিশুদের মতো খুশি হতে ভুলে যাই বলেই আমাদের এত্ত যন্ত্রণা। আমরা বড্ড ইনসেনসিটিভ আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠি।

আচ্ছা, লাস্ট কবে আমরা বাজারে ফুলের মাসির সব ফুল বিক্রি হয়ে গেছে বলে আনন্দে নৃত্য করে উঠেছি?

 হে হে... এতো অনেক বেশি আবদার করে ফেললাম নিজের কাছে।

আমি তো এমন ঘটনাও শুনছি যেখানে আমাদের বয়সী যুবক যুবতী রুপোলী রাংতায় মোড়া স্লিপিং বুদ্ধা দেখেও বলছে ' এ আর এমন কি, পলিউশন কম, তাই পাহাড়ে কুয়াশা নেই, ভালোই ' মানে কোনো উচ্ছ্বাস আমাদের আর ছুঁতে পারছেনা।

আমরা ঠিকই করে ফেলেছি, আমাদের জানলা গুলোকে অস্বীকার করে আমরা ঘুলঘুলির দিকে চেয়ে থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাব। আমাদের ‘ভালো থাকা’ আমাদের ভালো থাকতে চাওয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে ক্রমশ। তাই শুধু ছুতোগুলো খুঁজে বার করতে হয়।

blog-subha

এবার আসি দুটো মনখারাপের গল্প কিভাবে একটা মানুষ ও একটা চারপায়ীকে বন্ধুত্বে জুড়ে দেয়, সেই ঘটনায়।

 আমাদের কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি ভাই পলাশ এর একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে ছিল। সেই বাচ্চাটা হঠাৎ একদিন ‘নেই’ হয়ে গেল। খেলতে খেলতে কখন যেন পুকুরে ডুব। জল থেকে যখন ডাঙ্গায় তোলা হল, তখন আর সাড় নেই। ওদের গ্রামের বাড়ির ঠিক গায়েই ছিল পুকুরটা।

 পলাশ পনেরো দিন ডিউটিতে আসেনি। যেদিন জয়েন করল,  সেদিন সকালে অফিসে ওর পাথরের মতো মুখটা দেখে কেমন যেন হয়ে গেলাম।  আমার ‘স্যাটার-ডে উইকএন্ড’ নিঃসাড়। হয়ে গেল আমি

কাঁধে হাত রেখে কুশল বিনিময় করলাম। তবে সান্ত্বনা দেওয়ার সাহস হল না। কী হবে! মনে হল সান্ত্বনা বোধহয় মানুষকে আরও দুর্বল করে দেয়।

তার পর থেকে অফিসে প্রায় প্রতিদিন ওর সঙ্গে কথা বলতাম। কিছুটা সময় একসঙ্গে। বাজারদর থেকে খেলা সব বিষয়ে ওর সঙ্গে কথা হত। শুধু একটা বিষয় ছাড়া।  

দেখলাম পলাশ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করছে। সহকর্মী সিকিউরিটি দাদাদের সাথে হাসিঠাট্টায় যোগ দিচ্ছে আবার।

 পলাশ কুকুর এক্কেবারে পছন্দ করত না। দেখলেই দুঃচ্ছাই করতো। হঠাৎ একদিন দেখি গেটের বাইরে বসে থাকা একটা কুকুরের সঙ্গে ওর বেশ ভাব জমে উঠেছে। রোগাসোগা- ঝিমিয়ে পড়া একটা কুকুর। জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকত গেটের এপারে। তার সঙ্গে নিজের মনে কথা বলছে।

প্রায়ই চোখে পড়ত। একদিন এগিয়ে গেলাম।  

-মর্নিং স্যার।

-হ্যাঁ ভাই, গুড মর্নিং।

স্যার জানেন এর চারটে বাচ্চাকেই একটা গাড়ি তিন দিন আগে চাপা দিয়ে দিয়েছে। আমাদের গেটের সামনেই। স্বপনদা ডিউটিতে ছিলো।, ধরার আগেই পগারপার। ডাইভারটা পুরো ড্রিংকস্ করে চালাচ্ছিল স্যার। সেই থেকে কুকুরটা কিচ্ছু খাচ্ছেনা। কারুকে দেখে লেজ নাড়িয়ে সাড়াও দিচ্ছেনা।

আমি স্তব্ধ হলাম। অফিসের ব্যাগটা নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সদ্য সন্তানহারা সেই অবোধ প্রাণীটার মাথায় হাত রাখলাম। সে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল।

পলাশ চিৎকার করে বলে উঠল,  

' স্যার ও লেজ নাড়ালো, এই তিন দিনে প্রথম, এই স্বপনদা, ওর জল খাওয়ার জায়গাটা আর বিস্কুট নিয়ে এসো জলদি '

সেদিন আমার অফিস যেতে বড় দেরী হয়ে গেলো। কিন্তু বুকের ভেতর এক অদ্ভুত প্রাচীর ভাঙা শব্দে শান্তির কান্না এলো টলমলিয়ে। দুজন সন্তান হারার অসম বন্ধুত্বের এই সামান্য ঘটনায় কেন যে আমার মত এক যান্ত্রিক কেরানী সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো তার উত্তর আপনাদের কাছে থাকলে জানাবেন।

 

ছবিঃ লেখক 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...