বাসাবাড়ি গড়ি আমরা আগামী শিশুদের জন্য

সুপর্ণা ভট্টাচার্য, বজবজ 

 

'নব আনন্দে জাগো, আজি, নব রবি কিরণে'

 

পর্দা চুইয়ে আলো এসে পড়ছে বারান্দায়। প্রথম দিনের আলো। সেই আলোয় ঘুরে বেড়াচ্ছে আগুনরঙা প্রজাপতি। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। নীচে রাস্তায় বেড়া বিনুনি করা, ঘটি হাতা ফ্রক পরা এক রোগাভোগা মেয়ে। আলোর কণা গায়ে পড়ে ঝরণার মতো লাগছে। নতুন বছরের ইচ্ছারা আলোর ফুলকি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত।

আমি দূরবীণ দেখি। আমি রূপ আর অরূপের মধ্যে লড়াই দেখি। আমি মায়া দেখি। কামনা, বাসনা, অহং দেখি।  আমি প্রথম দিনে হাহাকার করে উঠি ’ও মেয়ে,সূর্য -পোড়া ছাই হয়ে যাবি যে’! আদিকন্যা মুখ তুলে হাসে। এ মুখ আমি আয়নায় দেখি রোজ!

ভাসো গো,হাসো গো,ভালোবাসো গো। ’এই বলে মিলিয়ে যায় সে কিশোরী।

আগুনরঙা প্রজাপতি হাতের পাতায় এসে বসে। পুরাতন বছর চলে যায়। ওই পথের বাঁকে,চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছি কতশত মুহূর্তকে। ওই তো, রেহানা মাসি বাসন মেজে মেজে ঝকঝকে করছে। তিনু কাকা স্বর্ণ চাঁপা গাছ বসাচ্ছে বাগানে।

ভাই ছাতা নিয়ে, বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে দিচ্ছে বোনকে স্কুলে। বন্ধুরা আইসক্রিমের কাঠি ধ'রে কলকল, ছলছল। পাড়ার জেঠিমার কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে তারা বাতির জন্য সূচ সুতোয় নাক ফুটিয়ে আসা। থিয়েটারের সংলাপ বলছি, ঘুম থেকে উঠে। প্রার্থনার মতো।

সব যে বড়ো প্রাণের। জীবনের  বাবা সাইকেলের রডে বসিয়ে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিচ্ছে আমাকে। মেঘ কলো। গঙ্গার ওপাশের আকাশে। বাবা ছিপ্ নিয়ে বসে জলের কিনারে। পাশে বসে আমার নিথর দৃষ্টি জলের বুদবুদে। ফাতনা ডুব ডুব ডুবুরি।

মা এখন কেমন চুপ । গাছের মতো। এই মা সন্ধ্যা ছটার পর বাড়ি ঢুকলে ,চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতো। ওই যে মাকেও আঁচল উড়িয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। একটুও স্বাধীন নই,এই ভেবে চোখে জল টলটলানি আমি।দাঁড়িয়ে বারান্দার গ্রিল ধ'রে।ফ্রিল দেওয়া বুকের কাছে,ঘটি হাতা ফ্রক বানিয়ে দিচ্ছে,পা মেশিনে, মা ই তো। গোটা ডিম সুতো দিয়ে অর্ধেক করে এক থালায় ভাত মেখে,তিন ভাই বোনকে ভাতের গ্রাস তুলে দিচ্ছে নিঝুম রাতে। আমাদের শ্যামল সুন্দর মা। আজ সেই পরাধীনতার জন্য মন পুড়ে যায়। এই নতুন বছরে। ইচ্ছা হয় ওই মায়ের কোলে নিঝুম বিশ্রাম নিই। গত বছরের সব অসুখের ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে আসুক নতুন বছরে।

কী সব ছোটো ছোটো পৃথিবী হয়ে গিয়েছিল গত বছরে,আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এ বছরে যৌথ খামার হোক, ইছামতী হয়ে এ ইচ্ছা নদীর কাছে বলি। নিজ নিকেতন ছেড়ে সব বাউল হই আমরা, পিছনে থাকুক দীর্ঘ মিছিল,যারা গান ধরবে মাটির পুরাতনী রাগে। এ ইচ্ছা লিখে রাখি মনের নীল রঙা পৃষ্ঠায়।

সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের হাত ধরি, তাকে বিশ্বাস করি।আপন মনের মাধুরী দিয়ে বাসাবাড়ি গড়ি আমরা আগামী শিশুদের জন্য। এমন ইচ্ছা ছড়িয়ে রাখি শুকনো ধূলিকণায়।

সব পুরাতন রয়ে যায় নূতনের দিনলিপিতে। অভিজ্ঞতা হয়ে।

 

এসো, পাশাপাশি হাত ধরি একবার।

এসো, ইচ্ছা আমাদের বিছিয়ে রাখি।

মাটি, জল আর বাতাসে

এসো, মুখোশ খুলে ফেলে

স্বচ্ছ হই। সুন্দর হই। সত্য হই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...