চিন্ময় মুখোপাধ্যায় (সালকিয়া, হাওড়া)
পুরনো বছরটার গায়ে জাফরানি রঙ ধরতে শুরু করেছে, পৌষের পড়ন্ত বেলার গাঢ় হলুদ রোদ্দুরে খুব পুরোনো একটা বারান্দায় পড়ে আছে তার বিদায়পত্র, চলে যাবার চিঠি, ঘড়ঘড় করে যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে গত দশকের রেডিয়োটা গাইছে,'তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন বনষ্পতির ছায়া দিলেন সারাজীবন'।
আমাদের চেতনায় একটা ঘোর লাগছে, বিদায়ের ঘোর, কী যেন পাইনি, কী যেন পাওয়ার কথা ছিল, কার জন্য যেন অপেক্ষায় কেটে গেল জীবনের অনেকটা সময়..... এইসব সাদাকালো হিজিবিজি কথা গতজন্মের স্মৃতির মতো ভেসে বেড়ায় শীতের স্বল্পপ্রাণ অপরাহ্নে। সময়ের বয়স বাড়ে,তার গায়ে জমে শ্যাওলার ঘ্রাণ, কাটাকুটির হিসাব একসময়ে উদাসীনতার হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যায়।
আমাদের ছেলেবেলায় বড়দিন বছর শেষ, নতুন বছরের শুরু এসবের তেমন একটা আড়ম্বর ছিল না। ২৫ ডিসেম্বর কেক আর ১ জানুয়ারী ক্যালেন্ডার বদল ছাড়া তেমন কিছু হেরফের হয়নি বাঙালির জীবনে। আজকাল ছোটখাটো কোনও উপলক্ষ্য পেলেই মুহূর্তে সেলিব্রেশন শুরু হয়ে যায়। এই উৎসবমন্দ্রিত জগঝম্পবেলায় বছর শেষ ও শুরুর সময়টা ক্যালাইডোস্কোপের মতো রঙিন ও আমোদিত হয়ে ওঠে। মহামারীর প্রান্তে এসে মানুষের উচ্ছ্বাস-ফোয়ারা বুঝিয়ে দেয় আর সব তত্ত্বকথা বৃথা, জগতে আনন্দ একমাত্র সত্য।
জীবন আসবে যাবে, গাছের ডালের আগায় নবপত্র সঞ্চার হবে, একদিন কালের নিয়মে হলদে খসখসে ত্বক নিয়ে ঝরেও যাবে - এই আবর্তনের সম্ হলো আনন্দ, জন্মেও আনন্দ মৃত্যুতেও আনন্দ, কারণেও আনন্দ,অকারণেও আনন্দ......'পরিপূর্ণম্ আনন্দম্'।
এই বছর শেষের তেহাইয়ের মুখে দাঁড়িয়ে যদি পিছনের পানে চাই, সেলুলয়েডের সাদাকালো ছবি দেখিয়ে দেবে - মহামারী, মহামারীর আতঙ্ক ও তার বাণিজ্যিক সদুপযোগ, বাণিজ্যসর্বস্ব পৃথিবীর অমানবিক মুখ, কর্মহীনতা, অবসাদ ও মৃত্যু, ভবিষ্যতের নিকষ অন্ধকার, ভালো থাকা ও খারাপ থাকার সঠিক সংজ্ঞা।
তবুও তো জীবন ভোরবেলাকার কল্লোলিনী নদীর মতো, যার প্রবাহ চিরন্তন মহাজীবনের মতো। হাজার দুঃখরাতের শেষেও একটা পরম নির্ভরতার ভোর থাকে.... নতুন একটা বছর আসছে, মহাজাগতিক দর্শনে হয়ত কিছুমাত্র হেরফের হবেনা, তবুও আমাদের ক্লিষ্ট জীবনের দিনগুলো একটু সুন্দর হবে, একটু আনন্দময় হবে, সুখের ভাগ পাবে দূর ও নিকটের পড়শীরা। এভাবেই আসুক নতুন বছর,সুখে-দুঃখে,প্রেমে-অপ্রেমে।