ঐন্দ্রিলা মুখোপাধ্যায়
শিবপুর, হাওড়া
প্রেম কী?
এই বিষয় নিয়ে যতবার ভাবতে বসেছি ততই মনে হয়েছে প্রেম একটা ঐশ্বরিক অবস্থা মাত্র। আমি আমার ‘গহীন বাড়ি’ উপন্যাসে বলেছিলাম, ‘যখন মানুষ নিজের মধ্যে ঈশ্বর দেখে, তাকে বলে ধ্যান। যখন মানুষ সবার মধ্যেই ঈশ্বর দেখে, তাকে বলে জ্ঞান। আর মানুষ যখন কোনও বিশেষ একজনের মধ্যে ঈশ্বর দেখে তখন তাকে বলে প্রেম।'
আসলে আমাদের প্রতিটা মানুষের মনের অন্ত্যমিলেই নিরন্তর জারি থাকে সমকালীন এক খোঁজ। আর খুব সত্যি বলতে প্রতিটা মানুষের মাঝেই নারী-পুরুষ দুটো সত্তাই থাকে। তাই কল্পনার নারী বা পুরুষের প্রতি যে আকর্ষণ তা কিন্তু একটি মানুষের মধ্যস্থিত ভিন্ন সত্তার অনুরূপ এক আত্মানুসন্ধান মাত্র। এখানেই একটি পুরুষ তার পুরুষোচিত আচরণের বাইরে কতটা নারী মনের অধিকারী আর একটি নারী তার সুকোমল নারী মনের আড়ালে কতটা পুরুষকারে দৃপ্ত- তাই বোধহয় অর্ধনারীশ্বর চেতনার জন্ম দেয়। আর এই চেতনা কিন্তু স্বার্থসিদ্ধ কোনও প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির চেতনা নয়। পার্থিব ও অপার্থিবের মাঝে এক ব্রহ্মচেতনা যা কিনা ভালোবাসা বা প্রেম নামে ধরা দেয়।
মজা আর আনন্দের মধ্যে যেমন এক সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, তেমনি প্রেম আর ভালোবাসার মধ্যেও আছে। ‘ভালোবাসা’ শব্দটি বড়ই আটপৌরে, কোথাও না কোথাও শর্তাধীনও বটে। কিন্তু ‘প্রেম’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে, অনেকটা ভেসে থাকার মতো, শর্তহীন। প্রেম সম্পূর্ণরূপে মনজ বা মন আর শরীর উভয়ের সংমিশ্রনজাতও হতে পারে। একটু বিশদে বললে, আমাদের মধ্যে যে নিরন্তর খোঁজ তা যতটা অপেক্ষার ততটাই মধুর। আসলে জীবন তো নদীর মতই বহমান। আর সেই বহতা নদীর বাঁকে বাঁকে থাকে এক একটি চরের অপেক্ষা।
যদিও সেই অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হলে মানুষের মনে বিরহ আসে, বিরহে বিষাদ আসে, বিষাদ অবসাদ আনে আর সেই অবসাদেই জন্ম নেয় বৈরাগ্য। আর এই বৈরাগ্যের এক নাম যদি মীরা হয় বিরহের অপর নাম রাধা। অথচ এই অপেক্ষা বিরহ বৈরাগ্য সবই কিন্তু এক মোহাবিষ্ট অবস্থা থেকে উৎপত্তি হয় , যার নাম প্রেম। তাই প্রেম গভীরতর হলে অপেক্ষা প্রশমনেও তা স্থির থাকে। হয়তো সেখানে মিলনের আর্তিটুকু থাকে না কারণ মিলন মানেই তো আরও এক নতুন খোঁজ, অফুরান আরও এক চাওয়া। যাকে দমন করতে পারলেই কিন্তু ভালোবাসা ঐশ্বরিক হয়। যেখানে থাকে না কোনও হারানোর ভয় বা প্রতীক্ষার যন্ত্রণা। যেখানে থাকে শুধু প্রশান্তিই প্রশান্তি । সেখানে অপেক্ষাও বড়ো মধুর। সেই ভালোবাসাই তো উপাসনা। আর সেই উপাসনাই প্রেম।
তাই এক কথায় বলতে গেলে প্রেম এমন এক মোহাবিষ্ট অবস্থা যা প্রকারান্তরে মুক্তির একমাত্র পথ। কারণ বিশ্বাস আর সমর্পণই তো মুক্তি তথা প্রেমেরও গোড়ার কথা।