কোহিনূর মিত্র,কলকাতা
প্রেম এক ক্ষণস্থায়ী মেদুর মানসিক অবস্থা।খুঁজে পেয়েছি বলব না, তবে মিহি একটা কিছু যা প্রেমের মতো তা অনুভব করেছি। কিশোরীবেলায় গরাদের ফাঁক থেকে হিন্দিতে লেখা চিঠি পেয়েছি ড্রাইভারের ছেলের। পড়তে পারিনি। স্নানের ঘরে চিঠির লাল কালিকে রক্ত দিয়ে লেখা ভেবে রোমাঞ্চিত হয়েছি। শীতের বিকেলে সখীদের সঙ্গে বড় মাঠে যাওয়ার চল ছিল। সেখানেও চোখ ঘষে যেত দু একজনের সঙ্গে। রাতে শরীরে একতারা বাজত। তাদের আলতো হাসি,গভীর চাহনি মনে করে চোখের কোলটা ভিজে যেত।মনে মনে অবাক লাগত,"হল তবে,কালো মেয়েটারও প্রেম হল!"
তখন মফস্বল শহরকে নকল করেনি। ধানক্ষেতের মাঝে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া জল ভরা বড় বড় গর্ত ছিল। সেই জলেই প্রেমের শপথ চলত। তখন প্রেম আর বন্ধুত্ব এমন গুলিয়ে যায়নি। প্রেম প্রেম-ই ছিল। তাই প্রেম করে পালিয়ে বিয়েরও বেশ চল ছিল। সে ভারি মজার। একটা পাড়ায় এমন হলেই সব মেয়েরা কিছুকালের জন্য গৃহবন্দী ছেলেরা কিন্তু নয়। তারা তখনও বন্ধ জসনলায় সাইকেলের বেল বাজিয়ে সিটি দিয়ে ঘুরে বেড়াত। তখন খারাপ মেয়েরাই প্রেম করত। ভালো মেয়েরা কেবল বেণী ঝুলিয়ে রাস্তা পার হত। তাদের রক্ষাকর্তা তাদের ছোটো ভাইবোনেরা। যারা সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী, কিন্তু শত পাহারা সত্বেও বসন্ত বাতাস অনিয়ন্ত্রিত।
আরও পথ চলতে চলতে প্রেম বেশ বড় আকার নিয়েছিল। নানাধরনের প্রেম। যা ভালবাসি তাই প্রেম। অনবরত প্রেমে পড়ি। সে এক ভীষণ সময়। নিজেকে নিজেই হারাই, খুঁজে পাই, আবার হারাই। আকাশ বাতাস হাওয়া জল ফুল পাখি হাসি কান্না সর্বোপরি যৌবন ভালোবাসি। গানে গল্পে ছবিতে কবিতায় সর্বত্র, ‘প্রেমের জোয়ারে ভাসিব দোহারে বাঁধন খুলে দাও’র মতো ব্যাপার!
কিন্তু প্রেমের তথাকথিত মানে অনুযায়ী একজন ব্যক্তি তো চাই যে আসলে ভাসাবে। পেলাম একজনকে। অরূপরতন। বেশ চলল কিছুকাল। মিহি মিহি হাতে হাত সুখী সুখী ভাব আহ্লাদে আটখানা প্রাণ। জীবনটা যেন টলটলে রূপনারায়ণ ঝলমলে রোদ্দুরে।
কিন্তু এই যে অনুভূতি সে তো আমার একার নিজস্ব। বেশিদিন থাকল না। কেমন মলিন হতে হতে হারিয়ে গেল।এবার অনবদ্য একজনকে পাওয়া গেল।মনে হল এই সেই ও শেষজন। যার জন্য সেই কবে থেকে জমিয়ে রেখেছি গন্ধর্ব ঘর আমার শরীরে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সবাই আমার বানিয়ে তোলা। আমার মনের মাধুরী মাখিয়ে নির্মাণ করি তার মন। সে মনের যা কিছু দেখি তা তো আসলে আমারই নিভৃত স্বজন। আদতে কোথাও কিছুই নেই বুঝি। কোনো প্রেম নেই। আমি আসলে আমার সাথেই প্রেমে মগ্ন। তাই সেও ভেসে গেল একদিন অকুলে। এরপর বয়েসে ছোটো ,বয়েসে বড় কতজন। কেউ বলে গেল, কেউ ছুঁয়ে গেল, কেউ চেয়ে চেয়ে রয়ে গেল। আমি ভাবতেই থাকলাম এই বুঝি সে এল। স্নানঘরে,বারান্দায়,ছাদের আলসেতে,সিঁড়ির চোরা অন্ধকারে দেখাও হল। হলুদ সর্ষে খেতে, কোপাই-এর পারে, বরফের রাতে, মণিপুরের জঙ্গলে তাকে অনুভবও করলাম। যার সাথে রইলাম যখন, তখনই মনে হল সেই বুঝি প্রেম আমার।
এখন একলা বসে থাকি সন্ধ্যেতারার নীচে। স্থানের ঠিক থাকে না। আসে পাশে কেউ আছে বা নেই। কিন্তু এক আশ্চর্য আলো ঘিরে ধরে।এই বুঝি রয়ে যাবে প্রেম। আজকাল বহুদূর যেতে হয় লংড্রাইভে। কত গ্রাম, ফলভরা খেত, নদীর পাশ দিয়ে দিনরাতের সীমানা পেরিয়ে চলি। কখনো কুয়াশা, কখনও বৃষ্টি ফোঁটার ছায়া, কখনও রোদ ছুঁয়ে যায় মুখ গাল চোখের কোল। কেমন মায়াবী নেশা লাগে যেন জন্মান্তর কোনও। আমি ভেবে নিই প্রেম, যে আমাকে ছেড়ে যেতে পারেনি আজও... ভেতর থেকে বুঝি বারবার উন্মাদ হতে ইচ্ছে করে। অচেনা অজানা কত মুখ ভালো লেগে যায়। উত্তেজনার পারদ উঠানামা করে অনন্ত রাত্রি। অসম্পূর্ণ ও লাগে। যেন পাওয়া হল না। কাছে যাওয়া হলো না। অসীম বিরহের তীরে কেবল কান্না আসে। জীবনভর এই খেলাই চলবে। সাদা বালির চরে দাঁড়িয়ে কেবল দেখব পায়ের পাতায় জল এল, কিন্তু রইল না। এই প্রেম এই জীবনসুধা। এই ক্ষণিকা,অসীম যার রেশ...