সুমনা সেন গুঁই, কলকাতা
আমার হাতেই বদলের চাবিকাঠি যদি আমি বদলাতে চাই। বদলাতে চাইলেই জীবনের গতি রুদ্ধ তালাটা যতই জং ধরুক বদলের চাবি দিয়ে ঠিক খুলে ফেলা সম্ভব হয়।
জন্মসূত্রে আমি একজন মেয়ে। তাই নারীত্বের সকল প্রকাশ আমার মধ্যে বিরাজমান। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন প্রকৃত আদর্শ নারী বলতে সঠিক ব্যাখ্যা কি তা যদিও আজও জানিনা। তবুও ছোট থেকে শুনে এসেছি মেয়েদের অনেক কিছু করতে হয় আবার অনেক কিছুই করতে হয় না। এই ‘কী কী করতে হয়’, আর ‘কী কী করতে নেই’-এর নিয়মাবলীগুলো ছোটবেলায় কেমন যেন শর্তাবলী প্রযোজ্যর মতো ছিল।
তাই চোখ-কান বুজে বড়দের অনুশাসন এর মাধ্যমে রপ্ত করতে হয়েছিল ওই Do আর Don't এর ফিরিস্তি। যেমন, বাবু হয়ে বসো পা ছড়িয়ে বোসো না। আস্তে আস্তে মুখ নাড়িয়ে খাও, জোরে জোরে মুখে আওয়াজ করে খেও না। পাশ ফিরে শোও চিৎ হয়ে শুয়ো না। আস্তে আস্তে কথা বলো, জোরে জোরে কথা বলো না। এরকম আরও অনেক কিছু।
যাই হোক এভাবেই ‘মেয়েলি নিয়মে’র বাধা নিষেধের মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে উঠলাম একদিন। ঠিক যতটা বড় হলে একটা মানুষের মধ্যে নিজস্ব চিন্তা ভাবনার যুক্তির একটা মঞ্চ থাকে।
কিন্তু আমি এমন অনেককেই দেখেছি যারা নিজের মধ্যে প্রশ্ন করে না। তাই সব কিছুই সহজে মেনে নেয় অন্ধের মতো। তারা যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না। গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যায়। কিন্তু আমি মনে করি এটা ঠিক নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পাল্টাতে হয়। পাল্টানো উচিৎ। আর তার জন্য এই সমাজকাঠামোয় নিজের মধ্যে যুক্তিগ্রাহ্য হওয়ার প্রশ্নটাও থাকা উচিৎ। তবেই না বদলের চাবিকাঠির প্রয়োগের প্রয়োজন বোঝা সম্ভব।
যে নিয়মটা মানছি, সেটা কেন মানছি? তার পেছনে যুক্তি কী? এই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে জাগলেই কিন্তু অনেক কিছু নতুনভাবে জানা যায় আর সেটাই কি প্রকৃত শিক্ষা নয়? যেমন বাঙালী হিন্দুদের বিয়েতে মেয়ে পিতৃগৃহ ছেড়ে যখন প্রথম শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হয় তখন পেছনে না তাকিয়ে একমুঠো চাল মায়ের আঁচলে ছুঁড়ে দিয়ে মাতৃঋণ শোধ করে। এটা কি কখনও সম্ভব? একমুঠো চালের মধ্যে মায়ের নাড়িছেঁড়া জন্মের ঋণ চোকানো কীভাবে সম্ভব!
বিয়ের কন্যা সম্প্রদানের নিয়মের যুক্তিও যুক্তিগ্রাহ্য লাগেনি। বৈবাহিক চিহ্ন শুধুমাত্র মেয়েদের কেন বহন করতে হবে? কেন আজকের আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে একজন রজস্বলাকে পূজা-অর্চনা শুভকাজ থেকে সরে থাকতে হবে? কেন একজন মেয়েকেই বৈধব্যের নিয়ম মানতে হবে? দুজন নারী পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সূত্রে এক পরিবারে থেকে ঘরের কাজের বেশির ভাগটা মেয়েদের সামলাতে হবে?
এরকম আরও অনেক কিছুতেই যুক্তি পাইনি তাই এমন রীতি মানিনি। নিজের ক্ষেত্রে বদলেছি নিয়ম। অন্যকেও অনুরোধ করেছি চিন্তা করে দেখতে। কারন, আমার হাতেই বদলের চাবিকাঠি। তাই বদলাতে এতো দ্বিধা কিসের? এখন যদি নারী পুরুষ সমান সমান বলে স্লোগান দেওয়া হয় তবে মেয়েরা কেন বাসে সংরক্ষিত সীটের জন্য সুবিধা নেবে? কেন বাসের সব সীটগুলো প্রবীণ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ হবে না? যাতে কোনো প্রবীণ বা প্রতিবন্ধী বাসে ট্রামে উঠলেই যেকোনো সমর্থ নারী বা পুরুষ সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে।
আমি অন্তত এটুকু করতে বা মানতে চেষ্টা করি। এমনকি কোনো পুরুষ মহিলা সংরক্ষিত সীটে বসে থাকলেও নিজের থেকে উঠতে বলি না বা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি না যাতে আমাকে দেখেই তিনি উঠতে বাধ্য হন। না কোনও মহৎ হওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। এভাবেই ছোট ছোট পদক্ষেপে আমি বা আমরাই পারি সমাজের কিছু অযুক্তিকর নিয়ম নীতিকে বদলে ফেলতে পারি। আমার বা আমাদের হাতেই আছে বদলের চাবিকাঠি।