একটা ছোট বিজ্ঞাপন দিয়ে সূত্রপাত। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ই নভেম্বর, রংপুরের জমিদার কালীচন্দ্র চৌধুরী 'সংবাদ প্রভাকর' ও 'রংপুর বার্তাবহ' দু'টি কাগজে বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, 'সুললিত গৌড়ীয় ভাষায়' কুলীনদের বহুবিবাহ নিয়ে একটি 'মনোহর' নাটক রচনা প্রতিযোগিতা হবে। যাঁর নাটক সর্বোৎকৃষ্ট হবে, তাঁকে ৫০ টাকা 'পারিতোষিক' দেওয়া হবে। অনেকেই নাটক রচনা করে জমা দিয়েছিলেন। সেরা বিবেচিত হয় সংস্কৃত কলেজ থেকে সদ্য পাশ করে বেরনো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হরিনাভি গ্রামের এক যুবকের নাটক, যার নাম রামনারায়ণ ভট্টাচার্য ওরফে রামনারায়ণ তর্করত্ন। ইতিহাস বলছে 'কুলীনকুলসর্বস্ব' নামের ওই নাটকটিই প্রথম বাংলা মৌলিক নাটক।
রামনারায়ণ জন্মেছিলেন ১৮২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার হরিনাভি গ্রামে। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম মৌলিক নাট্যকার ও হরিনাভি বঙ্গনাট্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা (১৮৬২)। রামনারায়ণের পিতা রামধন শিরোমনি সেকালের একজন নামকরা পণ্ডিত ছিলেন। তার দাদা প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।
রামনারায়ণ সংস্কৃত কলেজে ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রথমে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে প্রধান পণ্ডিত হিসেবে এবং পরে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। প্রায় ২৭ বছর তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৮৮২ সালে এই কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি নিজগ্রাম হরিনাভিতে চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনার দ্বারা বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। উলেখ্য, তাঁর অগ্রজ প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরও সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।
বাংলা মৌলিক নাটক রচয়িতা হিসেবেই রামনারায়ণের মুখ্য পরিচয়। তার রচিত কিছু নাটক হচ্ছে – স্বপ্নধন (১৮৩৩), কুলীন-কুল-সর্বস্ব (১৮৫৪), বেণী সংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞান শকুন্তল (১৮৬০), নব নাটক (১৮৬৬), সম্বন্ধ সমাধি (১৮৬৭), মালতী মাধব (১৮৬৭), চক্ষুদান (১৮৬৯), উভয়সঙ্কট (১৮৬৯), রুক্মিণী হরণ (১৮৭১), যেমন কর্ম তেমন ফল (১৮৭২), ধর্মবিজয় (১৮৭৫), কংসবধ (১৮৭৫)। পতিব্রতোপাখ্যান (১৮৫৩) তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। এখানে যেমন কর্ম তেমনি ফল (১৮৬৩), উভয় সঙ্কট (১৮৬৯), চক্ষুদান (১৮৬৯) হচ্ছে প্রহসন। তাঁর অধিকাংশ নাটক ও প্রহসন বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চ, কলকাতার অভিজাত ধনিকশ্রেণীর নিজস্ব মঞ্চ এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নাট্যশালায় বহুবার অভিনীত হয়। 'দি বেঙ্গল ফিলহার্মোনিক আকাদেমি' থেকে তিনি 'কাব্যোপাধ্যায়' উপাধি লাভ করেন।
বাংলা নাটকের ইতিহাসে অস্থিরচিত্ততা কাটিয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক সৃষ্টি হয় রামনারায়ণ তর্করত্নের (১৮২২-৮৬) হাতে। নাট্যকার হিসেবে তার প্রভূত খ্যাতিলাভের পেছনে রয়েছে তার সামাজিক নাটক "কুলীনকুলসর্বস্বের" (১৮৫৪) অভিনয় সাফল্য। এই নাটকটি নাট্যকর্মের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ অনুসারী না হলেও তা তৎকালীন বাংলা নাটকের মধ্যে বৈচিত্রের পরিচায়ক বলে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছিল।
লেখাটা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, এই 'কুলীনকুলসর্বস্ব' নামে নাটক রচনার জন্য পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার ঘােষণা করে রংপুরের কুণ্ডী পরগনার জমিদার কালীচন্দ্র রায়চৌধুরী যে প্রতিযােগিতা আহ্বান করেছিলেন তাতে বিজয়ী হয়ে রামনারায়ণ সে পুরস্কার লাভ করেন। এতে দেখা যায় রামনারায়ণের নাটক রচনা স্বতঃস্ফুর্ত ছিল না এবং নাটকের বিষয় ও নাম পর-নির্দেশিত ছিল। তবে নাটকটির বিষয়ের প্রতি সমগ্র জাতির কৌতূহলই রামনারায়ণকে জনপ্রিয়তা দান করেছিল। এই নাটকের মাধ্যমে দর্শকদের প্রবলভাবে মাতিয়ে তােলা সম্ভব হয়েছিল। সে কারণে তিনি নাটুকে রামনারায়ণ নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
কৌলিন্যপ্রথার দোষ নির্দেশক এই নাটকটিতে মূলকাহিনির শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। তাতে কতকগুলাে কৌতুকপূর্ণ দৃশ্য সংযােজিত হয়েছে মাত্র। একান্ত বাস্তব সামাজিক জীবনের ঘটনা অবলম্বন করাতেই এই নাটকটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান। কুলীনকুলসর্বস্ব' নাটকে যে কৌতুকরস স্থান পেয়েছে তা কোথাও করুণ, আবার কোথাও প্রহসনধর্মী। নাটকটির অন্য একটি বৈশিষ্ট্য এর টাইপ চরিত্রের প্রাধান্য। অমৃতাচার্য, অধর্মরুচি, বিবাহবণিক, উদারপরায়ণ, বিবাহবাতুল, অভব্যচন্দ্র এই সব নাম একদিকে যেমন ব্যঙ্গরসাত্মক, অন্যদিকে তাৎপর্যবাহী। হাস্যরসের আধিক্যের জন্য কোন কোন চরিত্র অবাস্তবতায় পরিপূর্ণ। সমস্যাপীড়িত মানবজীবনের অন্তরবেদনা, প্রথানুগত্যের পেছনে গােপন মর্মকথা, হাসির অন্তরালে অশ্রুর আভাস রামনারায়ণ তর্করত্নের এই নাটকটিকে জীবনরসােজ্জ্বল করেছে। বাঙালি শ্রোতা এ নাটকে সর্বপ্রথম নিজ সমাজপরিবেশে নিজের হাসিকান্নায়, বিরূপ সমবেদনায় দোলায়িত হয়ে আত্মপরিচয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। রাজা রামমােহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে নতুন সমাজচেতনা প্রবর্তন করেছিরেন তা-ই একটি বিশেষ সমস্যা অবলম্বনে রামনারায়ণের হাতে নাটকীয় রূপ লাভ করেছে।
সংস্কৃতে সুপণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন সংস্কৃত থেকে কয়েকটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। বেণীসংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৮৬০) ও মালতীমাধব (১৮৬৭)—এই চারটি নাটক সংস্কৃত থেকে অনূদিত। এদের স্বচ্ছন্দ অনুবাদে স্থানে স্থানে মূলের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। 'রত্নাবলী' নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়াতেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা নাটক রচনায় আত্মনিয়ােগ করেছিলেন।
রামনারায়ণ তর্করত্নের রুক্ষ্মিণীহরণ (১৮৭১), কংসবধ (১৮৭৫) ও ধর্মবিজয় (১৮৭৫)—এই কয়টি নাটক পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত। তিনি কয়েকটি প্রহসনও রচনা করেছিলেন, যথা : যেমন কর্ম তেমন ফল (১২৭৯ বঙ্গাব্দ), উভয় সঙ্কট (১৮৬৯), চক্ষুদান (১৮৬৯) প্রভৃতি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। সামাজিক সমস্যাই এই প্রহসনগুলাের বিষয়বস্তু। স্বপ্নধন (১৮৭৩) রােমান্টিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত নাটক। বাল্যবিবাহ প্রথার দোষ দেখিয়ে রচিত সম্বন্ধসমাধি নাটক (১৮৬৭) রামনারায়ণের রচনা বলে অনুমিত হয়।
সমকালীন সামাজিক দুর্নীতির প্রতি কটাক্ষপাত করে যে সমস্ত নাটক সে সময়ে রচিত হয়েছিল তাদের মধ্যে রামনারায়ণের 'নবনাটক' (১৮৬৬) শ্রেষ্ঠ। তার সমস্ত নাটকের মধ্যে একেই পূর্ণ নাট্যমর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথা বিষয়ক 'নবনাটক' এই নামকরণের মাধ্যমেই নাটকটির পরিচয় ফুটে উঠেছে। এই নাটকটিও পুরস্কার প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে পর-নির্দেশিত বিষয়ে রচিত। জোড়াসাঁকো নাট্যশালার পক্ষ থেকে গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ পুরস্কার ঘােষণা করেছিলেন। রামনারায়ণ এই নাটক রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য 'নবনাটক' প্রকাশের আগেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের নাটক প্রকাশিত হয়েছিল। রামনারায়ণ তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। নাটকের ভাষা-বিন্যাস ও পরিণতিতে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণের' প্রভাব লক্ষ করা চলে। বহু মৃত্যুজনিত ট্র্যাজেডি সৃষ্টি নীলদর্পণের প্রভাবের ফল।
অবশ্য 'নবনাটক' প্রকাশের আগেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের নাটক প্রকাশিত হয়েছিল। রামনারায়ণ তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। নাটকের ভাষা-বিন্যাস ও পরিণতিতে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণের' প্রভাব লক্ষ করা চলে। বহু মৃত্যুজনিত ট্র্যাজেডি সৃষ্টি নীলদর্পণের প্রভাবের ফল। রামনারায়ণ তর্করত্ন বাংলা নাটকের ইতিহাসে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। তার 'কুলীনকুলসর্বস্ব' নাটক তৎকালীন নাট্যসাহিত্যে প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। সমকালীন সমাজব্যবস্থার কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলাে নাটকে রূপায়িত করতে গিয়ে আঙ্গিকগত দিক থেকে তার চূড়ান্ত সার্থকতা লাভ করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু বিষয়বস্তুর গুণে শুধু তিনি যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তা নয়, বরং তার অনুবর্তী একটা নাট্যধারার সৃষ্টি সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। রামনারায়ণের নাটকের অভিনয় সাফল্যের পর থেকেই অভিনয় শিল্পে এবং বাংলা নাটক রচনায় প্রবল উদ্দীপনা দেখা দেয়। এর ফলে একদিকে যেমন অজস্র নাটক রচিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অভিনয়যােগ্য নাটকের প্রয়ােজন প্রকাশ পেয়েছে। ১৮৮৬ সালের ১৯ জানুয়ারি স্বগ্রামে তার মৃত্যু হয়।
এবার আসি বর্তমান হরিনাভি নাট্য সমাজের কথায়। সময় বদলেছে, পাল্টে গিয়েছে চারপাশের কত কিছু। রামনারায়ণের বসতবাটির আজ আর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু অস্তিত্ব আছে এই নাট্যসমাজের। এই সমাজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল প্রথমে ঘোষদের রাসবাড়ীর একটি ঘরে, যার প্রতিষ্ঠাফলক আজও রয়েছে। তবে বর্তমান রাসবাড়ী ভগ্নপ্রায় হওয়ার কারণে, ঘোষদের ভগ্নপ্রাপ্ত দূর্গাদালানের সীমানায় একটি অস্থায়ী ঘরে ঠাঁই নিয়েছে নাট্যসমাজ। সামনে একটি রামনারায়ণের আবক্ষ মূর্তি রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে। মূর্তিটি তুলনামূলকভাবে নতুন, কিন্তু সেটা ছাড়া নাট্য সমাজের সব কিছুতেই রয়েছে একটা দৈন্যভাব। রামনারায়ণকে মনে রেখেছে তার গ্রাম, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় থাকতে থাকতে... নাট্যপ্রেমীদের মন থেকে তিনি ধীরে ধীরে প্রায় মুছে গেছেন।
তথ্যসূত্র:
১. সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা- ৩৫২-৫৩।
২. সোনারপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য : হরিলাল নাথ।
---
সলিল হোড়
ঐতিহ্য গবেষক
কুঁদঘাট (দক্ষিণ কলকাতা)