তনুশ্রী চ্যাটার্জী
হাওড়া
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। কথা না বলে স্মৃতি বলাই ভালো।
এক শান্ত দুপুর। ফাল্গুন মাস। মাথায় বালিশ, চোখে তন্দ্রা নিয়ে অলীক জগতে ভেসে বেড়াচ্ছি। যত আজগুবি চিন্তা-ভাবনা সঙ্গী ছিল তখন। দুপুরটা যেন কেমন মায়া মাখানো। শেষ হতে চায় না।
বিকেলেও মন খারাপের গন্ধ। হঠাৎ করে দেখি পাশের বাড়ির এক বান্ধবী উঁকি দিচ্ছে জানালা দিয়ে। ডাকছে আমায়। কেন ডাকছে না জিজ্ঞেস করেই চললাম তার সঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত দেখি আমার বন্ধুনীটি এক পড়শির বাগানে নিয়ে এসেছে আমায়! সব চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিবেশীদের বাগান থেকে আম , জাম, পেয়ারা পেড়ে আনা যেন এক আশ্চর্য জগতে পাড়ি দেওয়ার মতো। আর এই ব্যাপারে আমার সুনাম ছিল। তাই ভাবলাম তেমন কোনও ডাক হয়ত এসেছে।
বাগানে ঢুকে দেখি ঘাসের রং সাদা। আমি তো দারুণ অবাক!
''এ কেমন করে হয়!"।
তখনই প্রথম পরিচয় হল তার সঙ্গে। সজনে ফুল। দুপুরের বাতাসে আকাশ ছোঁয়া গাছটা থেকে ঘাসের ওপর টুপটুপ করে ঝরে পড়েছে। অদ্ভুত গন্ধ। একেবারে অচেনা। চারপাশটাকে বেশ বদলে দিতে পারে। নিঝুম দুপুরের সঙ্গে মিলেমিশে কেমন একটা ঘোর লাগায়। ঘুঘুর ডাকও তখন অন্যরকম লাগে কানে।
এই বাগানের সজনে ফুল নাকি পাড়ায় খুব নামকরা।
আমার ফুল-ছাপ চুড়িদারের ওড়না ভরে গিয়েছিল সাদা-সাদা সজনে ফুলে। হালকা-পলকা ফুলগুলোর দিকে তাকালে কেমন মায়া লাগে।
সেদিন ফুল কী করে পেলাম সে গল্প বাড়ির লোককে আর শোনাইনি। কোনমতে যা হোক কিছু বলে মাকে রাজি করিয়েছিলাম রাঁধতে। মায়ের হাতের সজনে ফুলের বড়াই ছিল আমার প্রথম বসন্তের সবচেয়ে প্রিয় স্বাদ।
বসন্তের দুপুরগুলো আশ্চর্য রূপকথার মত হয়। না-শীত না-গরম এক অনুভূতি। মনে হয় কোন রাজপুত্তুর আর রাজকন্যের প্রেমের রং বোধ হয় আকাশে ছড়িয়ে রয়েছে। কখনও মনকেমন করে, মনে হয় এই বুঝি মন ভাঙা মেঘে বৃষ্টি এল। আবার কখনও মন গোলাপী ডানার প্রজাপতি। ইচ্ছে মতো উড়ে বেড়ায় গুলমোহর আর পলাশে পলাশে। এসবের খুব কারণ খুঁজে পাইনা দুপুরগুলোতে; তবে আমেজটুকু বারবার গায়ে মেখে নিতে ইচ্ছে করে। এই বোধহয় বসন্তরেণুর মাধুর্য...
আমার মত মধ্য পঞ্চাশের গৃহবধূর দুপুরের সঙ্গী রেডিয়ো বা বই। তবে বয়স আজকাল চোখকে বড্ড বকুনি দিচ্ছে। তাই বই পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ হয় না। স্মৃতির ভিড়ে আছন্ন হয়ে থাকি বসন্তের দুপুরগুলোয়। পরিবারের পছন্দের পদ হিসেবে কখনো রান্না করি সজনে ফুল। কিন্তু হাতা, খুন্তি, কড়াই ছেড়ে মন তখন পাড়ি দেয় সেই দুপুরগুলোয়, যখন প্রায় রোজই সেই বান্ধবীর সঙ্গে সজনে ফুল কুড়োতে যেতাম। আর বসন্ত চলে গেলেই ফুস-মন্তরের মত উধাও হয়ে যেত সজনে ফুলেরা। আবার এক বছরের কঠিন অপেক্ষা।
তবে প্রথম বসন্ত বলতে আজও মায়ের হাতের সজনে ফুলের বড়ার কথাই মনে পড়ে। নিজে এই পদ রান্না করলেও মন ভরে না। বাড়ির লোক খুশি হলেও আমার মন উড়ে বেড়ায় সেই ছেলেবেলার স্মৃতিতে। এভাবেই আমার প্রথম বসন্তের স্বাদ, গন্ধ সবই স্মৃতির ঝাঁপিতে বন্দী।