শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মূল সুর কিন্তু থেকে গিয়েছে একই

সুজাতা দত্ত

প্রধান শিক্ষিকা, বাঁশবেড়িয়া গার্লস হাইস্কুল, হুগলী  

 

 

 

শিক্ষক দিবস। ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে শিক্ষক- শিক্ষিকাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের দিন। যদিও সারাবছরই তারা এটা করে থাকে, এবং শুধু স্কুলে নয়, স্কুলের বাইরেও। তবু আজকের দিনটায় বিষয়টা একটু অন্যমাত্রা পায়। আমরা যখন ছাত্রী ছিলাম, সেই সময়ের তুলনায় এখন বাহ্যিক আড়ম্বরের আতিশয্য বেশ খানিকটা বাড়লেও শিক্ষক দিবস উদযাপনের মূল সুর কিন্তু একই থেকে গিয়েছে।

 

ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন আর উল্টোদিকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষ থেকে তাঁদের স্নেহের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সৌহার্দ্য প্রকাশ। আমি  এই দিনটায় এখনও আমার পুরনো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ফোন করে প্রণাম জানাই, তেমনি আমার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা, যারা এখন অনেকেই নিজের জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত তারাও ফোন করে। কুশল বিনিময় হয়।

 

এই বিশেষ দিনটিতে সত্যিই একটা আলাদা তৃপ্তি মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। দেশে দেশে যুগে যুগে শিক্ষক দিবস একই রকম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল আছে আর থাকবেও। বিবর্তন ঘটেছে শিক্ষা ব্যবস্থার। বিবর্তিত হওয়াটা জরুরীও। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সূত্রে প্রতিটা মুহূর্তে বুঝতে পারি এই অভিযোজন কতটা জরুরী।     

 

আধুনিক শিক্ষা বোঝাহীন ও শিশুকেন্দ্রিক। অন্তত ২০০৫ ন্যাশনাল ক্যারিকুলাম ফ্রেম ওয়ার্ক আর ২০০৯-এর রাইট টু এডুকেশন তেমনটাই বলছে। এবার এই ‘বোঝা’ কি ‘পাঠক্রমের বোঝা’ নাকি ‘পাঠক্রম না বোঝার বোঝা’, তা আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট নয়।এখন সরকারী স্কুলগুলোতে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই প্রথম প্রজন্মের স্কুলপড়ুয়া। সরকারী নিয়মের যাঁতাকলে তাদের সিংহভাগই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় কিছুই না বুঝে পাঠক্রমের সামান্যতম অংশ বুঝে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে থাকে।

 

প্রত্যেকটি উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যে ‘না বোঝার’ একটা অদৃশ্য পর্দা বিকশিত হতে থাকে। এর ফাঁকে কিছু ছাত্র পারিবারিক অনটনে রোজগারমুখী হয় আর কিছু ছাত্রী অভিভাবকদের চাপে সংসারী হয়। এই ছাত্রছাত্রীরা বিনা প্রতিবাদেই তা মেনে নেয়। ইতিমধ্যেই পাঠক্রম তথা পাঠক্রমের বোঝা বয়ে চলা শিক্ষক আর ঐ শিক্ষার্থীর মধ্যে ‘না বোঝার’ অদৃশ্য অর্ধভেদ্য পর্দাটি রূপান্তরিত হয়েছে দৃশ্যমান অভেদ্য পর্দায়। পরিণতি ‘ড্রপআউট’।

 

এই ‘ফিজিক্যাল ড্রপআউট’ আটকাতে যতই নির্মাণ করা হোক বিভিন্ন প্রকল্পের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তাও এই ‘ড্রপ আউট’গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ‘তরুণের স্বপ্নের’ করুণ পরিণতি। তারপরেও এতসব আয়োজনের আশ্বাসকে অবলম্বন করে যেসব ছাত্রছাত্রী শ্রেণীকক্ষে থেকে যায় তারাও  কিন্তু সব সময় শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় মানসিক অংশগ্রহণ করে না। এরা আসলে ‘সাইকোলজিক্যাল ড্রপআউট’। আজ আমাদের কাছে সবচেয়ে ভাবনার জায়গা পড়ুয়াদের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটাই।

 

তথ্যপ্রযুক্তি বিস্ফোরণের যুগে আমাদের শিক্ষকদের বুঝতে হবে যে পড়ুয়াদের গতানুগতিক ‘চক অ্যান্ড টক’ পদ্ধতি আর বইয়ের সাদা কালো অক্ষরের গণ্ডীতে আর বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে পাঠক্রমের সঙ্গে জুড়ে বাস্তবজীনে তার প্রয়োগ শেখাতে হবে শিক্ষকদেরই। আগামী দিনে পেশাগত দায়বদ্ধতার বাইরেও নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদেই এটা আমাদের করতে হবে। নইলে শিক্ষকদেরও ডোডো বা ডাইনোসরের পথেই হাঁটতে হবে; তাদের নিশ্চিহ্ন করবে ই-লার্নিং-এর ভার্চুয়াল উল্কাপাত।

 

আমরা সবকিছু বুঝেও জেগে ঘুমিয়ে থাকব না প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার অচলায়তন থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হব সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ শিক্ষকদের উপরই রইল। তবে একজন পড়ুয়া স্কুলেই তার জীবনের সবচেয়ে ‘প্রোডাক্টিভ’ বারোটা বছর কাটিয়েও সে যদি শুধুমাত্র কতগুলো বিশেষ বিষয়ের বইয়ের পাতার সমষ্টি হয়, ‘জগতের আনন্দ যজ্ঞে’ নিজের যোগ্যতায় ‘নিমন্ত্রণ’ না পায় তা আমাদের ব্যর্থতারই নামান্তর মাত্র।  

 

আসুন, এই শিক্ষক দিবসের পুণ্যলগ্নে আমরা প্রার্থনা করি শ্রেণীকক্ষের ঐ প্রস্তরীভূত চেতনাকে আমরা যেন পাথরের মতো ঠুকে স্ফুলিঙ্গ নির্গমন করতে পারি যা আগামী দিনে দাবানলের রূপ নিয়ে বদলে দিতে পারে স্থবির ব্যবস্থাকে। আসুন সবাই কণ্ঠ ছেড়ে বলি-  

“উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত” ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...