সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন যেদিন ‘রাধা-কৃষ্ণ’ হয়ে গেলেন

 

আমি একটি আধা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। স্বামী মহাদেবানন্দ হাইস্কুল ফর বয়েজ স্কুলে আমাদের ক্লাস হত।

 

আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে ইংরেজি ওয়ার্কবুক পড়ানো হতো কারণ তখন প্রাথমিকে ইংরেজি পড়ানো ছিল মানা। পড়াতেন আমাদের হেডস্যার কিন্তু স্কুল ইনস্পেক্টর এলে, তা বলা বারণ ছিল।

 

হেডস্যারকে ভয় যেমন করতাম তেমন ভালবাসতাম-ও খুব। বাবা বলতেন, অনেক দূরে ওঁর বাড়ি, এখানে একা বাড়ী ভাড়া নিয়ে থাকেন। স্যারের কাছে আমরা ছিলাম সন্তানের মতো। আমাদের যেমন শাসন করতেন তেমন ভালোবেসে কাছেও টেনে নিতেন। হেডস্যার আমাদের ইতিহাস পড়াতেন।

 

নীল নদ, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু সভ্যতা, ব্যাবিলন সব যেন চোখের সামনে ছবি হয়ে উঠত, মন হারিয়ে যেত ওই সব প্রাচীন নগরে। আর পড়া না পারলে হাতে একটা করে বেতের বাড়ি পড়ত কিন্তু কখনও তার জন্য রাগ হয়নি, বা আমাদের বাড়ি থেকে কেউ যায়নি স্কুলে নালিশ জানাতে। কারণ সেই মারে শাসন যত না ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা। তখন থেকেই ইতিহাসের সাথে আমার ভালোবাসার শুরু। কিন্তু ইতিহাসের মনে হয় আমাকে পছন্দ ছিল না।

 

যাই হোক, আমাদের এই নিস্তরঙ্গ স্কুল জীবনে একদিন দেখলাম উঁচু ক্লাসের বড় দাদারা এসে আমাদের কাছ থেকে ৫ টাকা করে চাঁদা নিল। তার পরদিন স্কুলের গাছের কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া ফুল দিয়ে স্যারদের টেবিল আর ক্লাসরুম সাজানো হল।

 

দাদারা বলল, আজ আর কোনও স্যার কোনো ক্লাস নেবেন না...কারণ আজ শিক্ষক দিবস। ওঁদের ছুটির দিন। মানে, তখন কিছু না বুঝলেও এটা বুঝেছিলাম যে আজ আর গোবিন্দ স্যারের (আমরা নাম দিয়েছিলাম ঢোলগোবিন্দ) ভূগোল আর গদাধর স্যারের (নাম ছিল যম) অঙ্ক ক্লাস করতে হবে না। যাই হোক, একটু পরে বড় দাদারা এল আমাদের ক্লাস নিতে। বলা হল আজ গান নাটক গল্প হবে স্যারদের সঙ্গে।

 

দেখলাম, স্যারেদের মুখে অমলিন হাসি এবং কাচের প্লেটে সাজানো সামান্য মিষ্টি তারা কত আনন্দের সঙ্গে খাচ্ছেন। খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম তাদের এই ভাবে বন্ধুর মত মিশতে দেখে! সেটাই আমার প্রথম শিক্ষক দিবস। তখনও জানিনা সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন কে আর কেন-ই বা তাঁর জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।

 

তারপর পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম ক্যান্টনমেন্ট গার্লস হাইস্কুলে । ওখানে এসে শিক্ষক দিবসের আরও অনেক বেশি ব্যাপ্তি দেখলাম। আমাদের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন গৌরী ঘোষ। আমরা বলতাম ‘বড়দি’। বড়দিকে দেখে ঠকঠক করে কাঁপতাম;  এতটাই কঠিন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব।

 

এমনই এক ৫ সেপ্টেম্বর উঁচু ক্লাসের দিদিরা আমাদের অ্যাটেনডেন্স নিল, ক্লাস নিল। সেদিন দিদিরা শিক্ষিকা হয়ে একটু শাসনও করল, কিন্তু তাতে আনন্দ ছিল ভয় ছিল না। তখন বড়দি আমাদের বললেন শিক্ষক দিবস কি বা কেন। আমরা যখন ক্লাস নাইন আমরাও নিচু ক্লাসের ছাত্রীদের ক্লাস নিয়েছিলাম। এটা ছিল একটা অনাবিল আনন্দের পরম্পরা।

একজন ছাত্রী হিসেবে শিক্ষক দিবস উদযাপন করেছি অনেকবার। চাঁদা তুলে ঘর সাজানো, ফুল কেনা, দিদিদের মিষ্টি খাওয়ানো, নাচ, গান, আবৃত্তি আরো কত কিছু। তারপর কখন যে, আমি ওই শিক্ষক দিবস অনুষ্ঠানের অন্যতম অংশীদার হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।

 

আমার ছাত্রছাত্রীরা কী করে তাদের অমলিন ভালোবাসা দিয়ে আমার এই দিনটা ভরিয়ে রাখে তা প্রকাশ করার কোনও ভাষা নেই। আমার মনে আছে বালিগঞ্জের এক নামী বয়েজ স্কুলে প্রথম যে বছর আমার শিক্ষক দিবস ছিল একজন শিক্ষিকা হিসেবে; আমার কাছে চিরদিন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

যে ক্লাসটা করতে গিয়ে আমি বেশি ভয় পেতাম, যে ক্লাসটা ঠিকমতো শাসন করতে পারি না বলে, খুব বকা খেতাম প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে...সেই দুষ্টু ছেলেগুলো আজ দ্বাদশ শ্রেণীতে। রাস্তায় দেখা হলে যখন প্রণাম করে, কথা বলে, দেখি আমার কাঁধ ছাড়িয়ে কত বড় হয়ে গেছে!

 

তারাও আজ শাখা-প্রশাখা মেলতে শুরু করেছে। আমাকে ফেসবুকে বন্ধুত্বের অনুরোধ যখন পাঠায় নিজের কথা মনে পড়ে। হেডস্যার বলতেন ছেলে মেয়েরা বড় হলে বন্ধু হয়ে যায় রে। যখন স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার পর স্যার বা দিদিমণিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, দেখেছি, আমাদের জড়িয়ে ধরে তারা গর্বের হাসি হেসেছে।

 

যেন বলতে চেয়েছেন, “তোরা তো আমাদেরই হাতের তৈরী। শিল্পী যেমন মূর্তি তৈরি করে আমরাও সেইভাবে তোদেরও যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে তৈরী করেছি”। তখন আমার শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে নিজের বড় মিল খুঁজে পাই। মনে হয় আমিও তো ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-শাসন দিয়ে আমার ছাত্রছাত্রীদের তৈরী করেছি।

 

ভীষণ ভালো লাগে, যখন দেখি ছোট্ট-ছোট্ট হাতে তারা কার্ড বানায়, জড়িয়ে ধরে তাদের ভালোবাসা উজাড় করে দেয় তখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে।

 

একটা মজার কথা না বলতে পারলে আমার শিক্ষক দিবস অপূর্ণ থেকে যাবে। আমার এক সহকর্মী আমাকে বললেন, ক্লাস ফোরের শিক্ষক দিবসের ওপরে একটা বাংলা প্রজেক্ট দিয়েছে এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এর ব্যাপারে কিছু বুঝিয়ে কেমন ভাবে প্রজেক্টটা করতে হবে সেটা ক্লাসে আলোচনা করেছে।

 

সেইদিন একটি ছাত্রী অনুপস্থিত ছিল। কিছুদিন পরে যখন সেই অনুপস্থিত ছাত্রীটি প্রজেক্ট জমা দেয় দেখা যায় সে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এবং শিক্ষক দিবসের জায়গায় 'রাধা-কৃষ্ণ' নিয়ে একটি প্রজেক্ট তৈরি করেছে। সেই নিয়ে টিচার্স-রুমে তো হাসির ফোয়ারা....তখন নিজের কথা ভাবছিলাম...আমিও জানতাম না তখন কি শিক্ষক দিবস আর কে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। শুধু জানতাম আজ কোনও ক্লাস হবে না...

 

সোমশ্রী অধিকারী

শিক্ষিকা

ন্যাশানাল হাই স্কুল

কলকাতা

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...