সংঘমিত্রা মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপিকা, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি
ভাইফোঁটার পরে সবাই বাড়ী থেকে নাড়ু, নিমকি, সন্দেশ, ঘুগনি এইসব টিফিন নিয়ে যেতাম স্কুলে। তখন ক্লাস ইলেভেন, বিষয় আলাদা হলেও সবাই টিফিন আওয়ার্সে কমার্স-এর ঘরেই যেতাম। আমি গার্লস স্কুলে পড়তাম। আমরা ক’জন বান্ধবী সবসময় একসাথে। সবাই সবার টিফিন ভাগ করে খেতাম। খুব মজা হত। কেউ যদি কোন স্পেসশাল টিফিন আসত, এই যেমন- লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল, নাড়ু, মিষ্টি..... এইরকম কিছু তাহলে সেদিন অবশ্যই ভিড়টা একটু বেড়ে যেত। শুধু তাই নয়, সময়ে সময়ে আবার টিফিন চুরিও হয়ে যেত।
অবশ্য এই ‘চুরিটা’ নেহাত মজার জন্যেই। মনে মনে কোন গ্রুপ কাজটা করেছে সবাই জানত, কিন্তু যার টিফিন চুরি হবে সেই শুধু জানতে পারত না, পরে অবশ্য জানা যেত। সেরকম একটা মজার ঘটনা আজ মনে পড়ছে। গল্পটা আপনাদের বলেই ফেলি!
খুব মজাদার ছিল আমার স্কুলজীবন। আমাদের পাঁচ বন্ধুর একটা গ্রুপ ছিল, যারা সব সময় কিছু না কিছু দুষ্টুমি করে বেড়াত, আমরা পাঁচ বন্ধু সবসময় একসাথেই থাকতাম। সেবার বিজয়ার পর সবাই বাড়ী থেকে বেশ কিছু টিফিন নিয়ে গেছি। আমাদের এক বান্ধবী ছিল দিয়া। ও দেখি মালপোয়া আর পাটিসাপটা নিয়ে এসেছে। কে কী টিফিন এনেছি স্কুলে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়ে যেত। কাজেই আমরাও সেইভাবে সব খবর জেনে ঠিক করলাম, আজ কার টিফিনটা আগে চুরি করা হবে।
মালপোয়াটা কাকিমা, মানে, দিয়ার মা, খুব ভালোই করতেন। আমরা সবাই খুব হ্যাংলামি করতাম ওঁর হাতে বানানো খাবার নিয়ে। কাজেই সেদিনও তাই হল। ঠিক হল যে, দিয়ার টিফিন চুরি করে আগে মালপোয়া খাওয়া হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঠিক টিফিনের আগে ওর ব্যাগ থেকে টিফিনবক্স চুরি করা হল, আর সবকটা মালপোয়া ভাগাভাগি করে মুহূর্তের মধ্যে শেষ!
শেষে দেখা গেল দিয়ার জন্য একটিও রাখা হয়নি! আসলে দিয়াকে তখন অন্য কাজে আটকে রাখা হয়েছিল।টিফিনের সময় একটাও মালপোয়া না পেয়ে খুব রেগে গেল দিয়া। পরে অবশ্য আমরা এই কাজের জন্য বেশ অপরাধবোধে ভুগেছিলাম। কিছুটা আফসোস, কিছুটা খারাপলাগা মিলিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হয়েছিল না করলেই হত বোধহয় এসব!
মজার ছলে অনিচ্ছায় করা ভুল, নিজেরাই আর হবে না বলে কথা দিয়েছিলাম নিজেদের। আমাদের এই কাজের জন্য কখনো কিন্তু কাকিমা(দিয়ার মা)কখনও কিছু বলেননি। পরেরবার থেকে শুধু বেশি করে টিফিন এসেছিল, আর চুরি করতে হয়নি।
আজও যখন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, পুরনো স্কুলে যাই এই স্মৃতিই মনে পড়ে। সেদিনের বান্ধবীদের সঙ্গে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে গেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে হয়তো কথা হয় কখনও সখনও। স্কুলের রি-ইউনিয়নে দিদিমণিদের কাছে এরকম ঘটনাগুলো শুনলে মজাও হয় আবার একটু লজ্জাও করে। খুব মনে পড়ে ওইসব দিনগুলোর কথা। আজ এই কঠিন সময়ের মধ্যেও হাসির যোগান দিয়ে যায় এই ছোট ঘটনাগুলো।
এখন প্রাইমারী স্কুলের, হাই স্কুলের দিদিমণিদের সাথে রাস্তায় দেখা হলে খুব ভালোই লাগে, কখনো আবার মনখারাপও হয়ে যায়, অনেকে আজ আর নেই, তাঁদের বকুনি-শাসন যা পেয়েছি তাই আজ আশীর্বাদ মনে হয় বাহুল্যতার তুলনায় অনেকটা সাধারণভাবেই ছাত্রজীবন কেটেছে আমার। আমার মনে পড়েনা এখনকার মত আড়ম্বর করে শিক্ষক দিবস আলাদা কোনও একটি বিশেষ দিনে পালন করা হয়েছে। সত্যি তার কোনও প্রয়োজন হয় কি?
তাঁরা সন্তানস্নেহে আমাদের শাসন করেছেন, আবার উৎসাহও দিয়েছেন। প্রিয় দিদিমণিকে একটা ফুল দেওয়াই ভীষণ আনন্দ দিত। ওই দিনগুলো সবচেয়ে বেশি আনন্দের মনে হয়। কর্মশিক্ষার দিদিমণি ক্লাস ফাইভ থেকে টেন অবধি ওয়ার্ক এডুকেশনের ক্লাস নিতেন। আমরা বলতাম ‘হাতের কাজ’।
একবার আমার একটা মুখোশের কাজ দিদিমণির এত পছন্দ হল যে উনি নিজের কাছে রাখতে চাইলেন সেটা। সবাইকে ডেকে ডেকে দেখালেন। কাজ দেখে সবাই খুশি! এই ঘটনাটা বলার কারণ এটাই যে উনি শুধু শাসন করেননি ভালো কাজের প্রশংসা ও করতেন যথার্থভাবে। আজ নিজে কর্মজগতে প্রবেশ করে বুঝছি আমার এই ধারণা অনেক পাল্টে গেছে ।
অনেকটাই যেন দেওয়া আর নেওয়া। সেই আদর, সেই ভালবাসা, অকৃত্রিম স্নেহের আবদার, অনাবিল সহজ সম্পর্ক, বদলে যাওয়া সময়ে আজকাল কোথাও যেন সেসব খুব মিস করি...