এখনও যেন মাস্টারমশাইদের কথা কানে ভাসে

পিনাকী ভট্টাচার্য

প্রধান শিক্ষক, নবগ্রাম হাইস্কুল, হুগলী 

 

 

কিছুদিন আগেও দস্তুর মতন ছাত্র ছিলাম। এখনও যেন মাস্টারমশাইদের কথা কানে ভাসে।  বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভাবতাম পড়াশুনো কেবল বুঝি বিদ্যালয়েই হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম পড়াশোনার অভিমুখ স্কুল থেকে কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু বিপদ বাঁধল কয়েকটা নাম নিয়ে। কলকাতার বুকে স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন, দিল্লীতে দিল্লী স্কুল অফ ইকোনমিক্স অথবা লন্ডনের লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স- এরা কী করে স্কুল হল?

 

পরে জানতে পারলাম স্কুল কথাটাকে আমরা খুব সহজভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে মূল বিষয়টি এড়িয়ে গেছি। প্রাচীনকালে যখন শিকারই ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা, তখন এক এক গোষ্ঠীর অভিজ্ঞ এবং প্রাজ্ঞ দলপতি  দিনের শেষে সে সবাইকে নিয়ে বসে তার ঐদিনের শিকারের গল্প শোনাত। এই আড্ডাখানাই হল স্কোল, যার থেকে স্কুল কথাটি নাকি এসেছে। সেই দিক থেকে স্কুল, কলে্জ, বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুই  বৃহৎ প্রেক্ষিতে আসলে স্কুল।  স্কুলের শিক্ষক, কলেজের লেকচারার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সকলেই আসলে ‘শিক্ষক’।

 

ঠিক এই কারণেই আমার ছেলে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো আমাদের যিনি ক্রিকেট খেলা শেখান তাকে কি আমি শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে পারি? সত্যিই তো কেবল তথাকথিত স্কুলের শিক্ষকেরা শিক্ষক আর বাকিরা শিক্ষক নন!! তাহলে তারা কি কিছু শেখাচ্ছেন না? এ আসলে ভাবনার দীনতা। মোদ্দা কথা একজন শেখাতে চায়, একজন শিখতে চায়। এই দুয়ের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা হলেই শিক্ষার পূর্ণ বিকাশ। 

 

প্রাচীন কালে যখন গুরুকূলে ছাত্র শিক্ষা নিতে গেলে, সকল ছাত্রর  কপালে ‘মন্ত্র’ জুটত না। অনেক শিক্ষার্থীই ‘মন’ কেন্দ্রিক শিক্ষায় (অর্থাৎ যেখানে conception প্রাধান্য পায়)পারদর্শী হতো না। তারা কায়িক(তনু)পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের এবং সমাজের গতিকে অব্যাহত রাখত। ঘটনাচক্রে তাদের কাজের থেকেই ‘তন্ত্র’ কথাটি নাকি এসেছে। কিন্তু সে ভিন্ন কথা, মূল বিষয় হলো মানসিক ও কায়িক পরিশ্রমের যোগফল আমাদের সমাজ।

 

যখন কেউ কায়িক পরিশ্রম করে তখন তাকেও বুদ্ধির সাহায্য নিতে হয়, তাই তাকেও সঠিক রাস্তা চয়নের জন্য গুরু বা শিক্ষকের কাছে যেতে হয়। সঠিক শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তখনই তৈরি হয় যখন সমাজ এই দুই শ্রেণীর ছাত্রকেই অন্তত কাজের নিরিখে সমান চোখে দেখে।

 

কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সমাজে আজও সকল কার্যকে সমান চোখে দেখা হয় না। তাদের একরকম শ্রেণীবিভাগ আমাদের মনে থেকে যায়। সেই কারণেই যখন একজন চাষির ঘরের ছেলে অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তখন তার কপালে যে বাহবাটা জোটে, একজন অধ্যাপকের ঘরের ছেলে যদি সফল চাষী হয়ে জীবন কাটাতে চায় তখন ততোটাই হা হুতাশ তার জন্যে বরাদ্দ হয়। সবাই কে ‘হোয়াইট কলার জব’ করতে হবে যে না হলে পাড়ায়, আত্মীয় স্বজনের কাছে মান থাকে না।  ঠিক এই কারণেই অধিকাংশই শিক্ষার গণ্ডি পেরোনোর পর দিশেহারা হয়ে পরে।

 

স্কুলে গিয়ে কী হবে এই প্রশ্ন এক সময় এক শ্রেণীর ছাত্র দের মনে চলে আসে, আসতে বাধ্য। আমরা শিক্ষকেরা যদিও নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য বলে থাকি ওইসব ছাত্র-ছাত্রীদের তেমন ‘খিদে’ নেই কিন্তু বাস্তব হলো তারা যা ‘খেতে’ চায় সেই খাদ্য বিদ্যালয়ে ‘বাড়ন্ত’। যে মেয়েটি  সুন্দর সেলাইয়ের কাজ করতে পারে তাকে ‘পিথাগোরাস’ দিয়ে ঘায়েল করে, যে রান্না শিখতে চায় তাকে ‘শাহজাহানের’ সামনে ফেলে কিংবা ছেলেটি বা মেয়েটি খেলতে চায় বা শিল্পী হতে চায় তাদের ‘নিউটন’ দিয়ে কুপকাত করে এক বিমলানন্দ লাভ করে তৃপ্তির চোঁয়া ঢেঁকুর তুলে রাতে শুতে যাই। আর তারা প্রথাগত স্কুলের বাইরে গিয়ে আরও শিক্ষকের সন্ধান করে অন্নের জোগানের জন্যে। শিক্ষা যদি অন্নের যোগান না করতে পারে তবে সেই শিক্ষা অব্যবহৃত অলংকারে পরিণত হয়।

 

অন্ন পেটে না থাকলেও কিন্তু শিক্ষা হয় না। আরুণি ঋষির পুত্র শ্বেতকেতু যখন ব্রহ্মবিদ্যা জানতে চায় তখন তার বাবা তাকে বলে তুমি দিন পনেরো না খেয়ে থাকো তারপরে এসো। শ্বেতকেতু সেই মতো পনেরো দিন পরে আসে, কিন্তু তার কিন্তু ঋক্ সাম কোন বেদই আর মনে পড়ে না। তারপরে বাবার আদেশ পেয়ে যখন সে খাওয়া-দাওয়া করে আসে তখন সে অনেক স্বচ্ছন্দেই তার বিদ্যা বিহার করতে পারে তার বাবা তাকে বলে দেয় মন অন্নময়। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায়  

 

  অন্য বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা ;

 অন্য ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।

অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই  কবিতা

অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।।

 অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার।

 অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওঁকার।।

 সে অন্য যে বিষ দেয়

 কিংবা তাকে কারে

 ধ্বংস করো ধ্বংস করো

ধ্বংস করো তারে ।।

 

বিদ্যালয়গুলিতে দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থা এইভাবে ‘স্কুলে গিয়ে কি হবে’ এর একটা সদর্থক বার্তাও দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি একদিকে যেমন এক শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের চিন্তার ভার কমেছে, একই সাথে অপর একশ্রেণীর কাছে এটাই ‘লক্ষ্যর থেকে উপলক্ষ্য’র দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি।  শরীরের মাপের চেয়ে ছায়া যদি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় তবে বুঝে নিতে হয় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এই সূচকই এক বিরাট সংখ্যক পড়ুয়াকে সরকারী পরিকাঠামোর বাইরে নিয়ে আসছে। একদিকে ‘বেসিক নিড’ আরেকদিকে আমাদের ‘প্রত্যাশা’ এই দুইয়ের সংঘাতে শিক্ষাব্যবস্থা অনেকগুলি প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে।

 

তবে শিক্ষক হিসাবে যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে সেটি কিন্তু এর কোনটিই নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজ বহির্ভূত নয়, তাই যে কোনও সামাজিক পরিবর্তনের ছায়া প্রতিষ্ঠানে পড়তে বাধ্য। আমার চোখে এই মুহূর্তে একটি গুরুতর সামাজিক ব্যাধি মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতা। স্বাভাবিক ভাবে  প্রভাবও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছে।

 

আমি যদি একজন শিক্ষককে নিয়োগ করে ক্রমাগত ভাবতে থাকি ‘এর উপর নজরদারী করতে হবে না হলে সে ফাঁকি মারবে তখন আমি কিন্তু নিজেই নিজে কে অবিশ্বাস করে ফেলি। একই সন্দেহ ছাত্রছাত্রীদের নিয়েও হয়। হয়তো এই কারণেই আজ আমরা সিসি টিভি দেখতে পাই। সে যাই হোক, এই বিপরীত চিন্তার সূত্রপাত কিন্তু ছাত্র জীবনেই হয়ে থাকে। এই বিষয়ের একটা সুন্দর উদাহরণ আজকের পড়ার ছন্দ।

 

পড়াশুনা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের উপর বিশ্বাস গড়ে না ওঠার ফলে ছাত্রছাত্রীরা অসম্ভব রকম গৃহশিক্ষক নির্ভর হয়ে পরে। এই ধারা চলতে চলতে আজ এই রোগ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে, যা কিনা শিক্ষার অন্তিম পর্যায়। আমরা যেমন সিসিটিভি ক্যামেরা যত্রতত্র বসিয়ে আমাদের অবিশ্বাসের জায়গাটিকে প্রতিনিয়ত শান্ত করতে চাই, একজন ছাত্র সব সময় অন্যের সাহায্যে শিক্ষা নিতে নিতে নিজের মেরুদন্ড শক্ত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

 

পড়াশোনা শেষ হলে সার্টিফিকেট মেলে বটে কিন্তু তার মনে কতটা জোর তৈরি হয় তা সন্দেহের। এই কারণেই নতুন শিক্ষক পাওয়ার ক্ষেত্রেও আজকের দিনে এক রকমের মানগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শিক্ষক হিসাবে কাজ করার সুবাদে একাধিক ক্ষোভ বা দুঃখ মনে জন্ম নেয়। শিক্ষাকে যারা ভালোবাসে, বর্তমান পরিস্থিতির অনেক ঘটনাই তিনশো চৌষট্টি তাদের আহত করে। তাই অবশিষ্ট দিনটিতে এই দুঃখের এক সংক্ষিপ্ত খতিয়ান এখানে দিয়ে গেলাম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...