মহুয়া মল্লিক, শিক্ষিকা, বাঁশবেড়িয়া গার্লস হাইস্কুল
পুরুলিয়ার শান্তময়ী গার্লস হাইস্কুলের বিশাল কম্পাউন্ডে মা-বাবা যখন রেখে গেল ক্লাস ফাইভে, তখন ও বুঝতে পারিনি আমার একা একা পথ চলার শুরু হল। ছোট থেকেই আমি হোস্টেলে থাকতাম। মনখারাপ, একাকীত্ব যাঁদের স্পর্শে ভুলে থাকতাম তাঁরা আমার প্রিয় শিক্ষিকা।
ছোট থেকেই আমি বিজ্ঞান আর বাংলায় বেশি নম্বর পেতাম। ইতিহাস আমার কাছে ছিল ভয়ের বিষয়। কিন্তু সেই ইতিহাসকে ভালবেসে ফেললাম শিক্ষিকা নমিতাদিকে দেখে। দিদি কিন্তু সেই অর্থে ‘সুন্দরী’ ছিলেন না। অন্যান্য দিদিদের মতই সাদা তাঁতের শাড়ি পরে আসতেন। কিন্তু শাড়ি পরার ভঙ্গি, হাত খোঁপা আর ইতিহাসকে প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দেবার জন্যই মনে হয় মুগ্ধতা শুরু হল। আমার মুগ্ধতা দিদির চোখেও ধরা পড়েছিল নির্ঘাত। নাহলে এত স্পেশাল কেয়ার নিতেন কেন?
আমি ইতিহাসেও পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞান আর বাংলার মত নম্বর পেতে শুরু করলাম। এমনও হয়েছে দিদি সামনের রুমে পড়াচ্ছেন, আমি নিজের ক্লাস থেকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ক্লাস সিক্স তখন। আমার ক্লাসের টিচার বললেন, মহুয়া তুমি সামনের ক্লাসে গিয়ে বসতে পারো। কী লজ্জা! এসব নিয়ে নিশ্চয় স্টাফ রুমে নমিতাদির কাছেও কথা গেছে?
যাইহোক, এই ইতিহাস মুগ্ধতা আমার কেটে গেল ক্লাস নাইনে ওই স্কুল ছেড়ে বাবা মায়ের কাছে থেকে পড়াশোনা করার সময়। টিচার্স-ডে তে প্রিয় দিদিদের নিয়ে নানারকম অনুষ্ঠান করতাম। আর নমিতা দিদির মত পছন্দের দিদিদের জন্য নিজের হাতে কার্ড আর হাত খরচ বাঁচিয়ে যে সব ছাত্রীরা বাইরে থেকে আসত ওদের দিয়ে পেন আনাতাম।
এখন নিজে শিক্ষিকা হবার পর যখন আমার ছাত্রীদের ভালবাসা-উপহারে ডালি উপচে ওঠে ভাবি আমরা কত অভাগা ছিলাম ভালবাসার মানুষকে মন খুলে উপহার দিতেও পারিনি। একটা কথা বলতে খেদ নেই, খুব ভালবেসেছি আমার প্রণম্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।
আজ যখন ইতিহাস আশ্রিত গল্প উপন্যাস লিখি নমিতাদিকেই খুঁজি, দিদিই তো এই ভালবাসার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। ভালো থাকুন আপনারা ভালো রাখুন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে। প্রণাম আমার সকল শিক্ষক শিক্ষিকা আর সকল ছাত্রছাত্রীদের আমার স্নেহাশিস।