ছাত্রের মধ্যেকার বিপুল সম্ভাবনার মশলায় অগ্নিসংযোগের কাজটা করেন শিক্ষক

কৌশিক মুখোপাধ্যায়,

শিক্ষক, নবগ্রাম বিদ্যাপীঠ, কোন্নগর, হুগলী

 

 

শিক্ষক দিবস। দিনটা এলেই যেন মনে হয় দায়িত্বের গুরুভারটা আর একবার নতুন রঙে ধরা দিল। স্নেহ-শাসনের বাঁধনে। অনন্ত সম্ভাবনার বীজ হয়ে ছাত্র আসে শিক্ষকের কাছে। শিক্ষকের কাজ সেই বীজকে ঘুম জাগিয়ে গাছ করে তোলা।   

আমরা একটা কথা প্রায়ই বলি, কালীপুজোর সময়-"আমরা বাজি ফাটাই"।

 

 

কিন্তু বাজিকে কি কেউ ফাটাতে পারে?

পারে না। শুধু আগুন দিতে পারে। বাজির মধ্যেকার উপাদানে যে বিক্রিয়া হয়, তাতে বাজি নিজে নিজেই ফাটে, আলো আর শব্দে চমৎকৃত হয়ে যায় বিশ্বজগৎ। ঠিক তেমনি  শিক্ষক কাউকে কিছু করে দিতে পারেন না। তাহলে শিক্ষক কি করেন? তিনি শুধু এই বাজিতে আগুনটা দেন।

 

একটা ছাত্রভর্তি ক্লাসে শিক্ষক যখন কোন পাঠদান করেন, তখন ছাত্ররা সবাই কি সমানভাবে নিতে পারে? পারেনা। সমুদ্রের জল যখন বেলাভূমিতে আসে,  কোথাও গভীর গর্ত থাকলে সেখানে বেশি ঢুকে যায় আবার কোথাও সমতল থাকলে তার উপর দিয়ে চলে যায়....তেমনি, যে ছাত্রের মধ্যে জানার আকাঙ্ক্ষা বেশি থাকে সেখানে শিক্ষকের এই পাঠ প্রবেশ করে বেশি আর যার সেদিকে খেয়াল থাকে না, তার উপর দিয়ে সেই পাঠ সমুদ্রের জলের মতো আসে-যায়, যায় সে বুঝতেও পারে না।

শিক্ষকের কাজ, ওই সমতল জায়গাতে আস্তে আস্তে ছোট্ট থেকে গভীরতর গর্ত তৈরি করা, যাতে একটুও জল ফিরে না আসে....

 

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু গুণ থাকে যা আমাদের অন্যের থেকে আলাদা করে, আমার পৃথক অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই প্রকাশ পারিপার্শ্বিক অবস্থানির্ভর। সঠিক পরিবেশের অভাবে সে বৈশিষ্ট্য অপ্রকাশিতই থেকে যায়। ছাত্রের মধ্যেকার সেই বিশেষ গুণকে খুঁজে নিয়ে, যদি তাকে সেই দিক থেকে  উৎসাহিত করা যায়, তাহলে তার উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। ছাত্রের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী তার ভবিষ্যৎকে মানসচক্ষে দেখতে পারেন, একমাত্র সঠিক শিক্ষক। সেটাকে চিনে নিতে পারলেই...তাকে আর পড়াশোনার জন্য বারবার বলার দরকার হবে না। শুধু শুরুটা করে দাও!-তারপর সে নিজেই গড়গড় করে এগিয়ে যাবে তার অভীপ্সিত লক্ষ্যে।

 

যেমন, ছাত্রছাত্রীদের প্রাথমিক ভীতি যুক্তিনির্ভর শাস্ত্র গণিতে। ভাবের চেয়ে যুক্তিকে অনুধাবন করা একটু কঠিন বটে। কিন্তু তাদের যদি অংকে প্রথম থেকেই ভীতি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে  খুব মুশকিল। আমরা অংক ভুল হলেই বকাবকি, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি, যে পেরেছে তার তুলনায় সে কতটা খারাপ তাই নিয়ে বিস্তর কথায় ব্যর্থতার দায়টাকে আরো দীর্ঘতর করে তুলি। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র উপকার হয় না। অনেক সময় এই ধরণের বকাবকিতে ছাত্রের মধ্যে একটা জেদ চেপে যায়, যাদের কাছে অপমানিত হয়েছে তাদের উপর প্রতিহিংসা নেবার একটা ইচ্ছা জাগে। সেটা অংক করে না পারলেও-অন্য কোনো ভাবে সে এই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে, কিংবা যে করেই হোক অংক ঠিক করতে গিয়ে কোনো অসদুপায় অবলম্বন করতেও সে পিছপা হয় না।

 

কিন্তু উপায় টা যদি অন্য হত!-সে যতটুকু পারে, সেটাকেই বাহবা দিয়ে, অন্যের সাথে তুলনা না করে, অন্যরা কীভাবে পারছে, চিন্তাভাবনা করছে, সেই উদাহরণটা তাকে দিয়ে! সেক্ষেত্রে তার কোথায় ঠিক বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে, সেটা  জেনে নিয়ে, সেই ঘাটতি পূরণ করে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে দেওয়া এবং অংকের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে বাস্তব যোগ তাকে বুঝিয়ে বা ধরিয়ে দিলে, হয়ত সেটা সময়সাপেক্ষ, কিন্তু প্রাথমিকভাবে অংকে কম নাম্বার পেলেও, আস্তে আস্তে তার মধ্যে বিষয়টার প্রতি ভালোবাসা জন্মায় এবং সে ক্রমাগত উন্নতির দিকে যেতে থাকে। কোনো প্রতিহিংসার জন্ম হয় না।

 

শাস্তি বা বকাবকির বদলে ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের এতটুকু সহানুভূতিশীল মনোভাব তার অনেকটা বদল ঘটিয়ে দিতে পারে।শাস্তি বা বকাবকিতে সাময়িক ফল। কিন্তু একটু ভালোবাসায় যে বদল হয়,তার ফল থাকে সারাজীবন। তার মানে এই নয় যে তার অন্যায়কে প্রশয় দেওয়া,কিন্তু কোনো অন্যায় করলে, তার কাজটা শিক্ষককে কতটা দু:খ দিয়েছে,শুধুমাত্র সেই অনুভূতিটা তার কাছে বিস্তারিতভাবে বলা-এটাতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হয়।সে আস্তে আস্তে তার ভুল বুঝে অনুশোচিত হয় এবং ভালোর পথে চলে।

 

তাই শিক্ষক কোনও পারফর্মার নন,তিনি শুধু ছাত্রের মধ্যেকার বিপুল সম্ভাবনার মশলায় অগ্নিসংযোগের কাজটা করে দেন-তারপর সে নিজে থেকেই বিস্ফারিত হয়-বিচ্ছুরিত হয়, জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে তার প্রতিফলনে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...