মৌসুমী ঘোষ, নাকতলা
প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে বসন্তের পালে বাতাস লাগায়। উড়িয়ে নিয়ে যায় ঝরা পাতা- খোলা চুল। শিমূলে পলাশে আগুন ধরায় রুক্ষ পাহাড়ের বুকে, এমনকি হিসেবি মানুষের মনেও। এ এক চিরন্তন খেলা প্রকৃতি আর মানুষের।
আমার যখন বসন্ত আসার বয়স ছিল, তখন বসন্তকে আহ্বানের মন্ত্র জানা ছিল না। সে এসেছে।উথাল পাথাল করেছে, চলেও গেছে। পরে জ্ঞান বুদ্ধি হলে বুঝেছি ওটা বসন্তের প্রভাব ছিল- আমার কোন দোষ ছিল না।
বয়স বাড়ছে। বসন্ত কিন্তু আসা বন্ধ করে নি। অনেক সময়ই তা প্রকৃতির বসন্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয় নি। তাই কোনটা প্রকৃত বসন্ত আজও জানা হলো না।
যখন পুরোনো শুকনো পাতা ঝরে গিয়ে নতুন কচি পাতার জন্ম হয় তখন, না যখন মনের ধূলো ময়লা, পুরোনো আবর্জনা সরিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখে মন- কোন অচেনা মুখ বাঁচার গল্প নিয়ে আসে- পলাশের মতো মনের শিরায় উপশিরায আগুন ধরায় তখন।
প্রকৃতির লীলা খেলায় আমরা দাস মাত্র। তা বুঝে উঠতে বয়সের সূর্য মধ্যগগনে পৌঁছে যায়। আমরা সামাজিক বন্ধন রীতিনীতি দিয়ে মনের ভেতরকার প্রকৃতিকে ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করি- আমৃত্যু। তবু কারো কারো জীবনে সে হানা দেয় রবাহূতের মতো। তখন তাকে আমরা অস্বাভাবিক নাম দিই। মানতে পারি না। আমাদেরও পাতা ঝরে, নতুন পাতা জন্মায়। গাছের মতো, জীবনটা অবিচল থাকে হয়তো- কিন্তু পুরোনোকে সরিয়ে নতুনের আসাটা ঠেকানো যায় না।
গাছের মনের কথা জানি না। তবে মানুষের জীবনের বসন্ত কিন্তু বয়সের সঙ্গে রং বদলায়। আমার চোদ্দর বসন্ত আর চল্লিশের বসন্ত এক নয়। আবার জীবন যখন মাঝ আকাশের ওপাড়ে খানিক ঢলে পড়েছে তখন তার রূপ আলাদা।
প্রথম জীবনে বসন্তকে আঁকড়ে রাখার প্রবণতা ছিল। মনে হতো সব ভালো কিছু কেন চিরস্থায়ী নয়। তাকে কেন আঁচলে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখতে পারি না। তাকে হারানোর ব্যথায় বাকি সব মূল্যহীন হয়ে যেত।
আজ আর বসন্তকে ধরে রাখতে মন চায় না। মনে হয় যা কিছু ভালো তা ক্ষণিকেরই ভালো। সেই ক্ষণটুকুই চেঁটেপুটে গ্রহণ করি। কার্পেডিয়ম শব্দের উদযাপন করি। বারবার তাকে চলে যেতে দেখে মন তৈরী হয়ে যায় চলে যাওয়ার ব্যথা সামলাতে।
আমরাও গাছেদের মতো হয়ে যাই। প্রতিবার পাতা ঝরে যায়- নতুনের অপেক্ষায় থাকে মন।
ছবিঃ লেখক