মনে পড়ে যায় আমাদের বাড়ির বারান্দায় ছোট ছোট টবে করা মায়ের বাগান

সুমিত সুরাই

ইপসুইচ, ইংল্যান্ড

 

ইংল্যান্ডের আবহাওয়া এক কথায় বর্ণনা করতে হলে আমার মতে সবথেকে ভালো শব্দ হলো ছিঁচকাঁদুনে। মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টি যেন সারা বছর গোটা দেশটার উপর সেঁটে দিয়েছে কেউ। কলকাতার গরম আর আড়াই দিনের শীতে বড় হওয়া আমার যে ঠান্ডা ভালো লাগে না, তা নয়। বেশ লাগে সকালে উঠে জানালার বাইরে বরফের সাদা চাদর দেখতে, বা গরম জামাকাপড় জড়িয়ে হট চকোলেটের কাপ হাতে ফাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে। কিন্তু দুপুর সাড়ে তিনটেতেই অন্ধকার নেমে আসা আর অবিরাম বৃষ্টি বিরক্তি ধরায়, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় ডিপ্রেশন চেপে ধরে। ক্রিসমাসের আলোগুলো জানুয়ারির প্রথমদিকে নিভে গেলেই তাই অপেক্ষা শুরু হয় কবে বাড়বে দিন, পিছনের বাগানে উঁকি মারবে কাঠবিড়ালী আর গাছের ডালে ডালে ঝুলবে রঙ বেরঙের ফুল।

engg-flower

বসন্ত ধীরে ধীরে আসে না। হট্‌ করে একদিন পিছনের বাগানে উড পিজিয়নের ডাক শুনে খেয়াল হয়, আরে তাইতো, দিন তো এখন অনেকটাই লম্বা হয়ে গেছে! এমনিতে সারা বছর ওদের একঘেয়ে ডাক শুনে শুনে কানে এমন বসে যায় যে আলাদা করে আর কিছু মনে হয় না। কিন্তু শীতের ক'মাস পিছনের বাগান থাকে অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। তাই বসন্তের শুরুতে ওই একই ডাক অন্যরকম আনন্দ নিয়ে আসে। একটানা যেন বলে চলেছে “I don’t want to go”, “I don’t want to go”. এমনিতেও যতদূর জানি এরা শীতে কোথাও যায় টায় না। তাহলে সারা শীত সাড়াশব্দ যে কেন করে না, আর শীত শেষ হলে কেনই বা “যাব না, যাব না” বলে আবার ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে, তা বোঝা দায়।

eng-cherry

খাতায় কলমে মার্চের শুরু থেকেই এদেশে স্প্রিং। তবে এবছর আবহাওয়া একটু বেশিই খারাপ। একদিন রোদ ওঠে তো চারদিন মুখ ভার। তারই মধ্যে একদিন বাজার ফেরত চোখে পড়ল একটা গাছ ভরে গেছে গোলাপি ফুলে। চেরি ব্লসম। নাম শুনেছি অনেকদিন, তবে প্রথম দেখা এদেশে এসেই। সাদা বা গোলাপি, পাঁচ পাপড়িওয়ালা সব ফুলগুলোকেই প্রথম প্রথম চেরির ভাবতাম। পরে জেনেছি বিভিন্ন রকম চেরির সঙ্গে অন্য জাতের ফুলও আছে। এই কবছরে কয়েকটা চিনেছি, বাকি না চিনে উঠতে পারলেও অবশ্য ক্ষতি নেই কিছু। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে কবেই বা আর জ্ঞানের প্রয়োজন হয়েছে!

eng- cheryr1

সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকলেও কিছু পাড়ায় এদের দাপট বেশি। সারি সারি বাড়িগুলো থেকে যেন বিভিন্ন রঙের চামর ঝুলিয়ে দিয়েছে কেউ। ঝরে পড়া পাপড়িতে ফুটপাতগুলো গোলাপী সাদা মোজাইক করা মনে হয়। তবে শুধু চেরি নয়, কাছে গেলে চোখে পড়ে ছোট বড় বাগানে হরেক রকমের রঙিন ফুলের বাহার। মনে পড়ে যায় আমাদের বাড়ির বারান্দায় ছোট ছোট টবে করা মায়ের বাগান।

হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ি পাশের পার্কে। শহরটা ছোটই, তবে পার্কগুলো বিশাল। ঢেউ খেলানো সবুজ মাঠ আর ঝিল পেরিয়ে বড় বড় গাছের তলায় পাতা বেঞ্চের পাশে ঝুঁকে পড়েছে থোকা থোকা ফুল ভর্তি ডাল। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বুনোফুল আর তার মধ্যে দৌড়ে বেড়ানো কাঠবিড়ালি। সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় বোঝা যায় না। কলকাতার ভীড়ে অভ্যস্ত আমার এই পার্কগুলো খুব প্রিয়। সারা বছরই। তবে স্প্রিং আর ফলের সময় একটু বেশি।

eng-window

রাস্তার উপর বড় জানালাটার পাশেই আমার কাজের টেবিল। সোজা তাকালেই চোখে পড়ে পঞ্চদশ শতাব্দীর চার্চের চূড়োটা। বাঁয়ে আরেকটু দূরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো মিলের জায়গায় গড়ে ওঠা উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িটা। রাতে এখান থেকেও স্পষ্ট পড়া যায় সাদা নিওনে লেখা The Mill. তবে একটু একটু করে ঢাকা পরছে দুটোই। পাড়ার নেড়া গাছগুলো আবার জেগে উঠছে। ফুল আসছে। কদিন পরে ঝাকড়া হয়ে পাড়াটার চেহারাই পালটে দেবে। যদ্দিন না শরৎ আসে। আরেক দফা রঙের খেলা দেখিয়ে ঝরে পড়ে পাতা। তারপর আবার অপেক্ষা। পরের বসন্তের।

 

ছবিঃ লেখক 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...