আমার নম্বরের ঝুলি হাল্কা হত বসন্তের ছোঁয়ায়

এক্ষণ পাল, শিবপুর, হাওড়া

 

 

বসন্ত সব সময়ই রঙিন।

আর বসন্ত-এর কথা বললে সবার প্রথম আমার স্কুলের কথাটাই মনে পড়ে। স্কুল জীবনের মতো রঙিন আর কী বা আছে! ওটাই তো আমার বসন্ত।

ek

আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে মাধ্যমিক দিয়েছিলাম।

তারপরই স্কুলটা বদলে গেল আমার। অন্য একটা স্কুলে। অন্য একটা জগতে।

  কিন্তু  এখনও মনে লেগে আছে পুরনো স্কুলের সেই বসন্ত। গন্ধে- বর্ণে তাজা।

আমার স্কুল ছিল IIEST Campus-এর মধ্যে। প্রকৃতির ওইরকম সৌন্দর্যের কোনো তুলনাই হয় না। এইরকম একটা স্কুল জীবন যেখানে প্রকৃতি সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে সেখানে সত্যিই কিছু বলার নেই। বড়ো বড়ো লম্বা রাস্তা যতদূর চোখ যায় চলে যাচ্ছে সোজা। চারপাশে নানারকমের গাছ এবং তাতে নানাধরণের ফুল ও পাতায় রঙের বাহার। যেন Claude Monet ছবি এঁকে গেছেন এসে।

আমার মনে আছে শীতটা পার করেই  রংবেরঙের ছোট ছোট ফুল ও কচি কচি পাতা আসত স্কুলের গাছগুলোতে। দারুণ বিষয় যেটা ছিল, যখন হাল্কা হাওয়া দিত তখন ওই গাছগুলো থেকে কতো ছোট ছোট কুঁড়ি ও গাছের পাতারা একসাথে ঝরে পড়ত! এমন ভাবে ঝরে পড়ত দেখে মনে হত ঠিক যেন তুষারপাত হচ্ছে চারপাশে। জানালার ধারে বসে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে খালি তাকিয়ে দেখতাম ল। তাই হয়তো পরীক্ষাগুলোয় নম্বরের ঝুলিটা হাল্কাই থেকে যেত চিরকাল। ওই পাতা আর কুঁড়ি দিয়েই ভারি করতে হয় খালি।

 সাড়ে চারটের সময় ছুটি হত আমাদের। ছুটির পর তখন হাল্কা রোদ, সূর্য অস্ত যায় যায়। অস্ত যাওয়া সূর্যের সোনালি আলোয় চারদিক ভরে গেছে, চারপাশ থেকে আলগা হাওয়ায় ফুল ঝরে পড়ছে।

সত্যি প্রকৃতি কি অদ্ভুত সুন্দর এবং কতো শান্ত হতে পারে তাই না?

 এই বসন্তের দেখা  পেতে আমায় নিউ ইয়ার্ক বা আমস্টারডামের পার্কে যেতে হয়নি। স্কুলজীবন যে সত্যিই কতটা রঙিন ছিল আমার তার অন্যতম কারণ হয়ত এই বসন্ত।

spring-4 (1)

আর যেটা না বললেই নয়, আমাদের স্কুলের এর দুটো বাড়ি দুপাশে ছিল আর মাঝখানে একটা খাল কাটা ছিল, যেখান দিয়ে গঙ্গার জল আসত। সেই জলে আমদের Campus এ থাকা বড়ো জলঘড়িটা চলত। কথা সেটা নয়, ওই খালটার ওপর ছিল ছোট্ট একটা ব্রিজ।

সেই ব্রিজের ধারে একটা গাছ ছিল, যেটা বসন্তকালে হলুদ ফুলে ভোরে যেত এবং হাওয়ায় ঝরে পড়া ফুলগুলো সব রাস্তায় বিছিয়ে থাকত। গোটা রাস্তাটা হলুদ।  ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটি হলেই এসে ফুল কুড়ত, এখনও কুড়ায়, আমরাও ছোটবেলায় কুড়িয়েছি কত!

 কানে সবসময় একটা মিষ্টি জল বয়ে যাওয়ার শব্দ। ঠিক যেন  সিনেমার শেষের ক্লাইম্যাক্স...

ek-1

 

এখন যেন মনে হয় স্কুলজীবনে প্রথম টান আসলে কোনও মানুষকে নিয়ে ছিলনা হয়ত। এখন বুঝতে পারি আসলে ওই গাছগুলো, ওই ফুলগুলো, ওই পাখিগুলো আমায় টানত। যারা আমার স্কুলজীবনটার গায়ে তুলি বুলিয়ে গেছে।  ওদেরকেই আমি ভালোবেসেছিলাম। এখনও ভালোবাসি। সবাই হাওড়ার কথা বলে বি.গার্ডেন এর কথা বলে আর আমি নিজের স্কুলের কথা বলি। তাই তো প্রত্যেক নতুন বছর শুরুর পর বসন্তকালে স্কুলে যাই।

সেই মরচে পড়া গোলপোস্টটা। পাশে মাঠের  এক  কোণে বসে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল ছুটির পর একসাথে দৌড়ে আসা আর ফুল কুড়নো দেখি। ক্যামেরা থাকে তবুও কেন জানিনা একটাও ছবি তুলি না। খালি দেখি। তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে।

মুক্তি খুঁজে পেয়ে গেছি আমি। সেটার জন্য আর অন্য কোথাও যেতে হবে না আমায়। শুধু স্কুলের ফুটবল মাঠটুকুই যথেষ্ট। Akira Kurosawa এর Dreams আর আমার স্কুলের বসন্ত আমি কোনোদিন ভুলবো না।

 

"And the vision that was planted in my brain

Still remains

Within the sound of silence"

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...