আজ ২৫ শে বৈশাখ। আমার আপনার মুখ-পুস্তিকার দেওয়াল জুড়ে আজ কেবল রবি ঠাকুর । আজ দিকে দিকে রবি পুজো। সারা বছর যতখানি জুড়ে তিনি আমাদের মাঝে থাকেন তার চেয়ে বেশি। আজ সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে রবি ঠাকুরের জয়গান। তবে গোটা বছর জুড়ে আরও আরও ছবি চোখে পড়ে , যেমন "আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে" গানের দু'কলি জুড়ে রবি ঠাকুরের নাম, রাগ হয়। আমরা প্রতিবাদ করি, কারণ এ গান রবি ঠাকুরের নয়। কখনও চোখে পড়ে অদ্ভুত কিছু মন্তব্যের তলায় রবি ঠাকুরের নাম। আবার কিছু উগ্র-কনটেন্ট ক্রিয়েটর রবি ঠাকুরের গান কবিতায় অশ্লীলতার কালি লেপে লাইম লাইটে আসার চেষ্টা । আমরা বলি রবি ঠাকুরের অপমান, কিন্তু তাঁর গভীরতা অসীম। তাঁর তুলনা তিনিই। বিশালাকার সমুদ্রে এক ফোঁটা কালি ঢাললে সমুদ্র তার আঁচ পায় না, তেমনই । যদি আজ কবি থাকতেন নিজের সাবলীল রসিকতায় এসব মিম - কনটেন্টের জবাব কেমন ভাবে দিতেন ভাবতে বড় সাধ হয়।
আমার কাছে আমার রবীন্দ্রনাথ আধুনিক-মনস্ক। আজকের পান-জোক অথবা টু লাইনার, ঠাকুরের কলমের আনাচে কানাচে, ঠাকুরের রসিকতায় সেসব কবেই ট্রেন্ডে এসেছিল, আমরা আর সোশ্যাল মিডিয়া হয়ত তার খবর রাখেনি।
রবি ঠাকুরের চিঠিপত্র ঘাঁটলে অথবা তাঁর পরিচিত মহলের আলোচনা থেকেই মালুম হয় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আগাগোড়া একজন রসিক-বাঙালি।
শোনা যায় বার্ধক্যে কবিগুরুর শরীর একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। যখন তিনি লেখালিখি নিয়ে বসতেন উবু হয়ে ঝুঁকে পড়ে লিখতেন। একদিন তাঁর এক ছাত্র তাঁকে ওভাবে লিখতে দেখে বলেন " আপনার নিশ্চয়ই এভাবে লিখতে সমস্যা হচ্ছে , বাজারে একরকম চেয়ার পাওয়া যায় যেগুলোয় আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গেই লেখালিখি করতে পারেন " । এই শুনে কবিগুরু বললেন - " তা তো পারি। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।"
সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর সঙ্গে রবি ঠাকুর একবার ভ্রমণকালে আচমকা গুরুদেবের আহত-স্বর শুনে সুধাকান্তবাবু তাঁর দিকে তাকাতেই কবিগুরু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন- " পা কে চরনকমল বা পাদ-পদ্ম কেন বলে জান?" সুধাকান্তবাবুর অবাক চোখ দেখে রবি ঠাকুর মজার ছলে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বললেন " তাই যদি না হয়, তাহলে শরীরের এত জায়গা থাকতে মোজা ভেদ করে মৌমাছিটা পায়ের একেবারে তলায় হুলটা বিঁধালো কেন? "
সাহিত্যিক বনফুল ওরফে শ্রী বলাইচাঁদের এক ছোট ভাই বিশ্বভারতীতে পড়তে এলেন। শান্তিনিকেতনে পৌঁছে শুনেছেন রবীন্দ্রনাথ আজকাল কানে একটু কম শোনেন। তাই যখন তিনি রবি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন আর রবি ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন - " কী হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?"
তখন বলাইবাবুর ভাই চেঁচিয়ে জবাব দিলেন - আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।" মনে মনে হেসে রবি ঠাকুর বলে উঠলেন " না কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই!"
রবি ঠাকুর এমন অনেক শব্দের খেলা খেলতেন, যেমন বাঁদর ( আদতে বলার অর্থ বাম দিকের দরজা) , বৈবাহিক ( বই বহনকারী) ।
তাঁর মজার ছলে বানান শিক্ষার নমুনাও মেলে। একবার এক ছাত্র শূন্য বানানে 'ণ' লিখলে রবি ঠাকুর সেই ণ এর মাথা চেপে ধরে বলেন , " একে তো শূন্য তার আবার মাথা উঁচু কেন?" । এমন নানান রসিকতায় কত কত শিক্ষা তিনি বিলিয়ে গেছেন সবার মাঝে।
এই যে আজকের টু লাইনার, রবি ঠাকুর সেই কবেই রুমালে, কাগজে লিখেছিলেন। ১৯২৬ সালে হাঙ্গেরিতে থাকাকালীন তিনি লিখলেন - "এই লেখনগুলি সুরু (শুরু) হয়েছিল চীনে জাপানে। পাখায় কাগজে রুমালে কিছু লিখে দেবার জন্যে লোকের অনুরোধে এর উৎপত্তি। তারপরে স্বদেশে ও অন্য দেশেও তাগিদ পেয়েছি। এমনি করে এই টুকরো লেখাগুলি জমে উঠল। এর প্রধান মূল্য হাতের অক্ষরে ব্যক্তিগত পরিচয়ের। সে পরিচয় কেবল অক্ষরে কেন, দ্রুতলিখিত ভাবের মধ্যেও ধরা পড়ে... অন্যমনস্কতায় কাটাকুটি ভুলচুক ঘটেছে। সে সব ত্রুটিতেও ব্যক্তিগত পরিচয়েরই আভাস রয়ে গেল। "
সেই অণুকাব্যর কিছু কিছু রইল -
১ " দুঃখের আগুন কোন্ জ্যোতির্ময় পথরেখা টানে
বেদনার পরপার পানে। "
২ " দূর এসেছিল কাছে-
ফুরাইলে দিন, দূরে চলে গিয়ে আরো সে নিকটে আছে।"
৩ " স্তব্ধ অতল শব্দবিহীন মহাসমুদ্রতলে
বিশ্ব ফেনার পুঞ্জ সদাই ভাঙিয়া জুড়িয়া চলে। "
আদতে রবি ঠাকুরের বিশালতা বর্ণনা তেমন সোজা কথা নয়। আমরা ধীরে ধীরে তাঁর লেখায় ডুবে যাই, অর্থ বুঝি.. আবার পড়ে মনে হয় এবার নতুন কিছু বুঝলাম। অবশেষে ঠিক কতখানি বুঝতে পারি তার হিসেব রাখি না। আজ রবি-বারের এই ডায়েরির শেষ লাইনে কবির রচনাতেই হোক কবির আরাধনা ;
" সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর॥
কত বর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে,
অরূপ তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর।"
তথ্য :
রাণী চন্দ - গুরুদেব
চিঠিতে রবীন্দ্রচর্চা - অংশুমান ভট্টাচার্য
ইন্টারনেট (রবির আলোয়/ সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ ব্লগ)
নাম : প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী
শিক্ষাগত যোগ্যতা : বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)
পেশা : ফ্রিল্যান্স কনটেন্ট রাইটার।
শখ : বাংলা ভাষার পরিচর্যা করা। গান শোনা।