এক কবির গর্ভে আরেক কবির ঔরসে জন্ম নিয়েছিলেন নবনীতা। জন্মলগ্নে ‘নবনীতা’ নামকরণ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বড় হতে হতে শিক্ষক হিসেবে, সহপাঠী হিসেবে, সহকর্মী বা বন্ধু রূপে অনেক কবির সাথে জড়িয়ে গেছে তাঁর জীবন। এবং জড়িয়ে গেছে আমাদের মত অনেক অনামা অকিঞ্চিৎকর পাঠককূল, যারা কেউ কবি নন- অথচ যাদের জীবন কে কবিতার মতন করে চিনতে শিখিয়ে দিয়েছেন ওই এক আশ্চর্যময়ী। আজ তাঁর জন্মদিন।
আমার জীবনের খুব টালমাটাল একটা সময়ে রবিঠাকুরের গানের কাছে আশ্রয় খুঁজে নিই আমি। সেই সময় থেকেই বইকে বন্ধু করে নেওয়া শুরু। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর যে মানুষটা তাঁর নিরাময়ী যাদুস্পর্শ নিয়ে আমায় বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন- তিনি নবনীতা। আমি তখন ভেতর ভেতর তছনছ হয়ে যাচ্ছি। কোন কাজে মন লাগে না। সব বন্ধুকেই সুদূর, বিশ্বাসঅযোগ্য বলে মনে হয়। নিজের মধ্যে যে সব খামতি আর যার ওপর কোনই হাত নেই আমার- সে সবের সাথে কেমন করে মানিয়ে নেব বুঝতে পারছি না কিছুই। পারিপার্শ্বিক আঘাত, অবহেলা, অপমান শতগুণ হয়ে বুকের মধ্যে বাজছে। কাউকে যে সে কথা বলে হালকা হতে পারি তেমন কোন মুক্তাঞ্চল নেই তখন। তাই সেই সন্ধি-বয়সে সবার অজান্তে আমি খুব বিপদজনক হয়ে উঠছিলাম একা একা। এমন সময় দিম্মা আমায় পরিচয় করিয়ে দিল নবনীতার সঙ্গে। একটা পাতলা বই, ‘নাট্যারম্ভ’। সেই প্রথম নবনীতার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের শুরু। নিজের খামতিগুলোকে, না পারা কে, আঘাত আর অপমান কে, শরীরের যাবতীয় ব্যধি ও মনের সমস্ত বিরাগকে কেমন করে হাসির ছলে উড়িয়ে দেওয়া যায়, সমস্ত ছাপিয়ে জীবন কে কেমন করে সেলিব্রেট করতে হয় সেই খেলা আমায় শিখিয়ে দিলেন নবনীতা। শিখিয়ে দিলেন এই দুনিয়াতে একা হতে চাইলেও একা হওয়া যায় না আদতে। একখানা শক্তমুঠি সব সময় অলক্ষ্য থেকে আগলে রয়েছে। তাকে চিনে নিতে হয়। কৃতজ্ঞ থাকতে হয় তার প্রতি।
সেই থেকে কত লেখা, কত কবিতায় আমি আশ্রয় পেলাম। আরাম পেলাম। ‘ভালোবাসার বারান্দা’ –র আলো-হাওয়া, জল-জ্যোৎস্না, শোক-আহ্লাদ আমার জীবনকে আরো আদরের করে দিয়ে গেল। জীবনে কিছু মানুষ থাকে যাদের কাছে ঋণ ফুরতেই চায় না। নবনীতা তেমন একজন। মনকেমনের মতো সুন্দর।
নবনীতা আর আমার দিম্মা প্রায় সমবয়সী। অনেকসময় দেখেছি নবনীতার লেখার কথা বলতে গিয়ে কেমন ফুরফুরে এক আলো খেলা করে যাচ্ছে দিম্মার চেহারায়। যেন নিজের বাল্যসখীর গল্প শোনাচ্ছে আমায়। একই রকম নরম হয়ে ওঠে আমার মায়ের মুখ যখন মা নিজের ভালোবাসার গল্প বলে নবনীতাকে ঘিরে। নিজের কলেজ বয়সে কোন এক কলেজ-অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ নিয়ে মা একবার গিয়েছিল ভালো-বাসা বাড়িতে। মায়ের অটোগ্রাফ খাতার পাতা জুড়ে নবনীতা লিখে দিয়েছিলেন ‘নাম তার শুনিনি, সোহিনী না মোহিনী!’। গল্প হয়েছিল বেশ কিছুটা সময়। আমার মায়ের কলেজ বেলার ছবি আমি দেখেছি- লম্বা চুল, তন্বী চেহারা, দীঘল দুটো চোখ। শান্ত সুকুমারী সেই মার থেকে বয়স এখন সব লাবণ্য কেড়ে নিলেও যখন নবনীতার কথা ওঠে আজও, আমি সেই তরুণীর মুগ্ধ লালিত্য খুঁজে পাই আমার মায়ের ভেতর। আর মনে হয় নবনীতা যেন দিম্মার থেকে কবে একদিন আমার মায়ের গোপনকথা বলার অন্তরঙ্গ সই হয়ে গেছে, আমরা কেউ তার খবর রাখিনি।
আমার যে খুড়তুতো বোন, এজন্মের সর্বপ্রথম বন্ধু তিন্নি -ওর সাথে গল্পগাছায়, জন্মদিনের বই বিনিময়ে, আমাদের ভ্রমণের ধাঁচে জুড়ে গেছেন নবনীতা। আমরা অমন লোটাকম্বল নিয়ে বেড়িয়ে পরতে পারিনি বটে তবে হিচহাইক করে রেশন ট্রাকে চড়ে ম্যাকমাহনে গিয়ে পরতে বা একলা একলা কুম্ভে বেড়িয়ে যাবার ইচ্ছে পুষেছি। পাহাড়ে গিয়ে প্রকৃতিকে দেবতা বলে চিনতে শিখেছি। যদিও সেই অবুঝবেলা থেকে পরস্পরের বেড়ে ওঠার সঙ্গী আমরা এবং জীবনের অমোঘ নিয়মে ক্রমে ক্রমে অনেক অমিল এসেছে আমাদের পছন্দ-অপছন্দের তালিকায়, ভাবনাচিন্তার জগতে- তবুও নবনীতা কেমন অবিচল রয়ে গেলেন আমাদের মধ্যে। সেই ছেলেবেলার এক্কাদোক্কা খেলার মায়াবী আলোর মতো আন্তরিক।
শাশ্বত দা’র সাথে যখন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হত আর আমরা একটু একটু করে পরস্পরের সুখদুঃখের অংশী হয়ে উঠছিলাম। সেই সময় শাশ্বত দা’র গভীর মন খারাপ গুলোকে, যন্ত্রণাগুলোকে- কী করে এত দূর থেকে শুশ্রূষা দিতে পারি, আগলে রাখতে পারি তার কিছু স্থির করে উঠতে না পেরে আমি কেবল একটানা অনেকক্ষণ ধরে বিভিন্ন লেখা পড়ে শোনাতাম। তার মধ্যে ছিল তারাপদ রায়ের কবিতা, অবনীন্দ্রনাথের ‘নালক’, আমার ডাইরির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পাতা, ঋতুপর্ণের একের পর এক ‘ফার্স্ট পার্সন’ আর নবনীতার অনেক অনেক ‘ভালোবাসার বারান্দা’। আমাদের পাঠক্রম আমাদের এতটা নিবিড় করে রেখেছিল যে আজ যখন আর প্রায় কথাই হয় না আমাদের তখনও একইরকম ভালোবাসার নরম রোদ্দুর বিছিয়ে থাকে আমাদের নিভৃততম মনে। আর পরস্পরকে পরস্পরের ভীষণ বন্ধু মনে হয়।
অভীক আমায় গল্প বলেছিল ওর ছুটিতে উত্তরকলকাতার কোলাহলময় মেসবাড়ি ছেড়ে ও যখন কুচবিহারে নিজের নির্জন বাড়িতে যেত, তখন জমানো সবকটা ‘রোববার’ থেকে ‘ভালোবাসার বারান্দা’র লেখাগুলো ওর বই পড়তে সময় করে উঠতে না পারা সংসার-জর্জরিতা মা কে পেছন পেছন ঘুরে পড়ে শোনান ছিল ওর অন্যতম আনন্দের অবসরযাপন। কাজে-কর্মে, মনোযোগে-অমনোযোগে মায়ের মনেও সেঁধিয়ে যাচ্ছিল ছেলের পাঠ। তারপর ওদের পরিবারের এক চরম সঙ্কট আর দুশ্চিন্তার সময় ট্রেনে করে চিকিৎসাহেতু লম্বা সফরে যেতে নিজে নিজে পড়বার জন্য মা বেছে নিল সেই ‘ভালোবাসার বারান্দা’-কেই। অত দুশ্চিন্তার মধ্যে সে এক মুক্তাঞ্চল, যেখানে কিছুটা জিরনো যায়। জীবনের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়।
অভীক আমায় যতবার কথাপ্রসঙ্গে এই বর্ণনা দিয়েছে আমি মানসচক্ষে দেখেছি বেলা শেষের নরম হলুদ রোদ গাছের ফাঁক দিয়ে এসে লুটিয়ে পড়ছে ওদের একতলার ঘরের লাল মেঝেতে, ধুলো উঠনে। আর ফুরিয়ে আসা আলোর সাথে তাল রাখতে না পারা শশব্যস্ত মা এ-ঘর ও-ঘর ছোটাছুটি করে সেরে নিচ্ছে তার অসমাপ্ত কাজের রাশি এবং তার পায়ে পায়ে ম্যাগাজিন হাতে ঘুরে বেড়িয়ে আপন মনে পাঠ করছে কদিনের জন্য ছুটিতে বাড়ি আসা কিশোর ছেলে। দেখেছি আর চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে ভালবাসার জলে। গভীর মায়ায়।
গতকাল দে’জ পাবলিকেশন থেকে রবীন্দ্রসদনে নবনীতার আশিতম জন্মদিন পালন হল। সে অনুষ্ঠানে গিয়েছিল অভীক। অনিতা অগ্নিহোত্রী আর শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেওয়া আমার আশি বছরের বন্ধুনীটির দীর্ঘ আলাপচারী রেকর্ড করে পাঠিয়েছে আমায়। রাতে এখন ঘুম হয় না। শীতের রাতভোর শ্বাসের কষ্ট জাগিয়ে রেখে দেয়। তারই মধ্যে অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে শুনি নবনীতা আমার থেকেও বেশি হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ভাঙা কিন্তু আদুরে কণ্ঠস্বরে বলছেন কেমন করে যত্নশীল হতে হয় নিজের লেখার প্রতি। কীভাবে চিরঅসন্তুষ্টির সাথে ঘরবসত করতে হয় একজন কবিকে আর সেই কাটাছেঁড়ার পক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কেমন করে উঠে আসে এক একটা অপ্রতিম শব্দ, আশ্চর্য সব লেখা। বলছেন, ‘আমার দুটো চোখ এখনো দু’রকমই রয়ে গেল। একটা কেবল হাসে। অন্যটায় জল টলমল করে। যখন হাসি-কান্নার এই দৃষ্টি থাকে- কবিতা লিখি। কিন্তু সবসময় তো তা থাকে না। কখনো এমন হয় দুচোখেই হাসি বা দুটো চোখই কাঁদছে। তখন কবিতা আসে না। কবিতা আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কবিতার আশীর্বাদ লাগে।’ বলছেন, ‘লিখি বটে, কিন্তু ফেলে রাখি। সব তো ভালো লেখা নয়। বিচারটুকু করতে লাগে। হেলাফেলা করে হয় না। সাধনা চাই। আজ অব্দি অযত্ন করে কিছু লিখিনি। ’
নবনীতা যখন বলছেন- ‘জীবন আসলে কল্যাণময়। দুঃখ-কষ্ট তো থাকেই কিন্তু সেটা অন্য জিনিস। সেটা অকল্যাণ নয়। আমি বরাবর আমার লেখায় জীবনের সেই কল্যাণতম রূপকেই প্রকাশ করেছি। লালন করেছি। তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছি...’ তখন বিভোর হয়ে শুনতে শুনতে আবার আমি চোখের জলে ভাসছি।
আপনার কাছে এ জীবনে অনেক ঋণ আমার। অনেক কৃতজ্ঞতা। আপনি আমায় বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন যে জীবনটা আসলে খুব সুন্দর। সব দুঃখ, কষ্ট, শঠতা, প্রবঞ্চনা নিয়েও সুন্দর। সমস্তই পথচলার অঙ্গ। শুধু ভালো দিয়ে গড়া যায় না কিছুই। গড়া হলে তা shape পায় না যথাযথ। মূর্তি গড়তে গেলে মাটির সাথে তুষ মেশাতে হয়। সোনার সাথে খাদ না মেশালে সূক্ষ্ম হয়না তার কারুকাজ। নবনীতা, আপনি আমার সব আত্মক্ষয়ি অস্থিরতার আরাম। আজও...
পৌষ সংক্রান্তির আকাশ আমাদের সকলের শুভেচ্ছাবার্তার মতন রঙিন চৌখুপিতে ছেয়ে গেছে। নরম রোদে পা ছড়িয়ে বসে চিনতে পারছি এই যে আজীবনের মনকেমনগুলো এইখানেই আসলে আমাদের দেশ। এর মধ্যেই বসত করি আমি, আপনি, আমরা সবাই। সেই ভালোবাসার বারান্দার কাছে একদিন ঠিক আসতে হবে অন্যদের। না এসে উপায় নেই। অন্তত, যতকাল কবিতায় বাঁচি...
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া