বৈশাখের শেষে ছাদ পর্যন্ত ওঠা লতানে জুঁই গাছটা থোকায় থোকায় ফুলে নুয়ে পড়তে চাইছে। বেল, কামিনী গাছ ভরে আছে সাদা ফুলের ঝাঁপিতে। গন্ধরাজ ফুলের গন্ধে সন্ধ্যা সুবাসিত হয়ে যায় প্রখর তাপের সঙ্গে অসম যুদ্ধে। এবছর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ছুঁয়ে গেছে রাজ্যের বহু জেলায়। কলকাতার পিচ গলছে তেতাল্লিশ ডিগ্রির উদ্যাম ঝলসানো তাপে। বাঁকুড়ার অরণ্যে জ্বলে ওঠে দাবানল,সাইকেল নিয়ে পড়িমরি করে দৌড় দেয় কয়েকটি তরুণ প্রাণ। নেভাতে হবে আগুন। বাঁচাতে হবে অরণ্য। দাবদাহে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ছুটছে মানুষ কাজের ক্ষেত্রে।পেট তো ঋতু মানেনা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং মানেনা,মানেনা রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতিতে,সে অহর্নিশ জ্বলে। পরিযায়ী শ্রমিকদের যেমন জ্বলে,আইটি সেক্টর কর্মীদেরও পেট তেমনই জ্বলে। শীতল ছায়া ঘেরা গ্রামকে গিলে ফেলছে বিশাল বিশাল আকাশ ছোঁয়া আবাসন,,ঝকঝকে রিসোর্টে সাজানো,আধুনিক গ্রাম গিলে ফেলছে ধানক্ষেত। নদী,পাহাড় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে,বরফ গলছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের বিক্রি ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের মাথা অস্থির হচ্ছে,আমাদের মন অবশ হচ্ছে, আমরা চাতক পাখি হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। ‘গাছ লাগাও,পৃথিবী বাঁচাও’,,সত্য,সত্য এবং অমোঘ সত্য। অথচ যে সত্যকে আরো বহু চিরন্তন সত্যের মত উপেক্ষা করে চলছি আমরা,উপেক্ষা করে চলেছে রাজ্য,রাষ্ট্র।
প্রকৃতিকে তাচ্ছিল্য করে,তাকে ছিন্নভিন্ন করে এই যে তীব্র দহনে ছটফট করছি আমরা,মানুষ থেকে বৃক্ষ,পশুপাখি থেকে কীটপতঙ্গ,তাদের শান্তির বারি কে দেয়!,কে দেবে!
প্রকৃতি ব্যতীত কে আর দেবে! কেই বা দেয়!যাকে অবহেলা করি প্রতি ক্ষণে,সেই দেয় জীবন,কী ধৈর্য তার এখনও,কী সহনশীলতা তার এখনও!কিন্তু প্রকৃতি মায়ের মতই সোহাগের সঙ্গে শাসন করতে থাকে। সে শাসন আমরা মানি আর নাই মানি।
দীর্ঘ দগ্ধ দিনগুলোর মেঘেরাই অবশেষে এক দিন সজল হয়। সারাদিনের পুঞ্জীভূত জলসিঞ্চিত মেঘ উড়ে আসে আমাদের সকলের মাথার ওপরের ছাদ-আকাশে,কালবোশেখী ঝড়ের সঙ্গে। ঝরে পড়ে অঝোরে,তপ্ত মাটির বুকে। বাড়ির ছাদে। পথে প্রান্তরে। টুপটাপ শিলাবৃষ্টি হয় প্রবল ধারাপাতের সঙ্গে। বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে তীব্র শব্দে বাজ পড়ে। পথে থাকা মানুষ ভয় পায়,শুধু শান্তির ধারাপাত তো নয়,এ যেন আগামীর জন্য অশনিসংকেত। যেন বলে’,ঝড় আসছে গো, সাবধান হও’। সমূলে উৎপাটিত হয় দীর্ঘ বৃক্ষ। ভেঙে যায় অসহায় মানুষের টালির চাল।
বাজের আঘাতে খোলা জায়গায় মরে যায় কেউ কেউ। এই বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য রাজ্যে রাজ্যে কটি জলাধার আছে আমরা জানিনা। এই ধারাপাত ভরিয়ে দিতে পারত খাল,বিল,নদী জলাশয়।
বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে জলাশয় একটা একটা করে,অনৈতিক ভাবে,চুপিসারে। নদীর বুকে পলি জমতে জমতে পাহাড়। ধরণীর মাটি ঢেকে গেছে কংক্রিটে। বৃষ্টির জলে তাই পথঘাট ভাসে। রেললাইন ভাসে। ফিরতে পথের মানুষজনের গোড়ালি ডুবে যায়।
তবু, এই দহনের শান্তির বারি হয়ে আশরীর ভিজিয়ে দেয় আমাদের বৈশাখী বৃষ্টি। পশুরা আরাম পায়। পাখিরা স্নান করে। গাছেরা আনন্দে আকুল হয়।
বৃষ্টি শেষে সকলে নিরাপদে আশ্রয়ে ফিরলে বাড়িতে থাকা আপনজনরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
শ্রমিক বউটি বাড়ি ফিরে। ভিজে শাড়ি ছেড়ে, গোবিন্দ ভোগ চালের খিচুড়ি বসায়।
ব্যাঙ্কের ম্যানেজার স্ত্রীকে বলেন, ‘বুঝলে,একটু ঘন দুধ দিয়ে জমিয়ে কফি করো’।
টিউশন থেকে ফেরা ছানাদের মাথা মুছিয়ে দেয় মা। আজ রাত শান্তির।আজ রাত ঘুমের আরাম। আজ রাত আদর,ভালোবাসার।
সদ্য বিয়ে হওয়া নববধূ আজ সুন্দর করে নীল রঙের শাড়িতে সাজে। প্রেম আজ জেগে থাকবে, জাগিয়ে রাখবে।
সব সাদা ফুল ভিজে নরম হয়ে গন্ধ বিলায়,আজ শীতল হাওয়ার সঙ্গে তাদের মিতালী।
সুপর্ণা ভট্টাচার্য (লেখিকা, নাট্যকর্মী)
বজবজ