সঙ্ঘমিত্রা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা
'বাঙালির বাংলা ক্যালেন্ডার কি শুধু বৈশাখের?’
প্রথমেই বলতে হয় বাড়িতে বাংলা ক্যালেন্ডার এলে প্রথমেই চাকরীজীবির খোঁজ পড়ে দুর্গা পুজোর কত দিন ছুটি থাকবে তার হিসেব। আবার যদি ব্যবসায় যুক্ত থাকেন তখন দেখা হয় পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়া কবে পড়ছে। আবার সরস্বতী পুজোটাও দেখা হয়, যতই ভ্যালেন্টাইনস ডে থাকুক। ভাল লাগে যে এই দিনগুলো হাফ বেংলিশ ভাষার মত হয়ে যায়নি দেখে। যদিও সেটা পুরোটাই নির্ভর করে নিজের উপরে। অধুনা "আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা" এই সংস্কৃতি বেশি দেখি। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হবার ফলে কিছু বোধ এখনও বিলোপ পায়নি, পাবেও না। বাঙালি পোশাকে সাধারণ কিন্তু মননে আধুনিক ছিল,আছে এবং থাকবে ঠিক ততদিনই যতদিন নিজের ভাষায় কথা বলতে গেলে লোকে কি বলবে এটা উপেক্ষা করে চলতে পারবে।
একদিনের বঙ্গ ললনা, জামাই হয়ে বা নববর্ষ পালন না করে, কায়েমনোবাক্যে বাঙালি হয়ে উঠলে ভালই লাগবে। শাড়ি টাও যেমন থাকুক জিনসটাও থাকুক, সর্বশেষে আমার মনে হয় আজকের বাঙালি সত্যি একদিনের বাংলা ক্যালেন্ডারেই সীমাবদ্ধ হয় যাচ্ছে।আপনার উন্নতি অন্যের ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠুক এটা কোনও একটি টিভির বিজ্ঞাপনে বহুদিন আগে দেখান হয়,তখন ছোট ছিলাম বুঝিনি। কিন্তু আজ বুঝি খুব সুকৌশলে ভোগবাদ মগজে ঢোকানোর কাজ শুরু হয়েছিল এবং সাফল্য পেয়েছে বোকাবাক্সর হাত ধরে। এখন পোশাক, সাজগোজ এমন কি বিবাহর মতো পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান সব কিছুই অনুকরণ হচ্ছে বলিউডি সিনেমা এবং অভিনেতা অভিনেত্রীদের জীবনযাত্রার মতো করে। সামর্থ্যের বাইরে জানার পরেও তা করবার প্রচেষ্টা দেখে তাই মনে হয়।
শুভজন্মদিন-এর বদলে হ্যাপি বার্থডে উইশ করা হয়, পায়েস এর ঝকমারি এড়িয়ে আজকাল বাড়িতে বাড়িতে কেক আসে। ভোজ এখন জামা বদলে ‘পার্টি’ হয়েছে। গল্পস্বল্প হয়েছে চ্যাট। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারাটা মুশকিল। অহেতুক হিংসা, মিথ্যে কথার ফানুসে নিজেদের আটকে ফেলছি ক্রমাগত। নিজের ঢাক নিজে বাজানোর যুগ এখন। মূল্যবোধ, আপোষহীন আদর্শ এগুলো অতীতের ডাইনোসর, এখন সবটাই শপিং মল। একটা গাড়ি, ফ্ল্যাট না থাকলে জীবন বৃথা হয় যাচ্ছে। দাদু ঠাকুমার জায়গা বৃদ্ধাশ্রমে। আমরা হিমশৈলের মত বিক্ষিপ্ত হয় যাচ্ছি।
শক্তি, সুনীল, সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজীরা এক দিনের জন্যই ওই ক্যালেন্ডারে থাকেন। পরবর্তী প্রজন্মরা বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না, তারা হিন্দি, ইংরেজি জানে, এবং তাতেই তারা গর্বিত। আমরা আজও ওই অনুকরণকেই কখন যে অহং করে ফেলেছি বুঝিনি হয়তো।
এই জগাখিচুড়ী সংস্কৃতির আড়াল থেকে একদিন হেসে উঠবে আমাদের বাংলা ভাষা,বাংলার সংস্কৃতি.…..এই আমাদের নববর্ষের চাওয়া।