উমা বন্দ্যোপাধ্যায়
উত্তরপাড়া, হুগলী
নিজের আট জন দেওর ননদ, দু’ জন বড় ননদ আর নিজেরা আট বোনের মধ্যে দ্বিতীয় জন ছিলেন আমার মা। শ্বশুরমশাই রূপ দেখে শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে ঘরে এনেছিলেন আমার মাকে যখন সে আঠারোর কিশোরী। শ্বশুর বাড়িতে এসেই কোটা-বাটার দিদি থাকলেও ভাতের বড় হাঁড়িটা আর নানান পদ রাঁধতে হয়েছিল। দিদা (ঠাকুমা) কোনদিনই করেননি। বড়লোকের মেয়ে ছিলেন। আগে এই দায়িত্ব সামলেছেন আমার বড় দুই পিসি। দাদু ছিলেন রাশভারী মানুষ। বাইরের কারও হাতে খাবেন না।
শোনা কথা, রাত দেড়টার সময় গঙ্গার টাটকা ইলিশ দাদু কিনেছেন আর কোটা রান্না হয়েছে ঐ রাতেই। তখন ফ্রীজ ছিল না। আর মা সবসময়ে ঘোমটা দিয়ে দাদুর কথা, দিদার কথা শুনে চলতেন।
এমনও শুনেছি, দাদু বলেছেন একদিন শুক্তো করতে। সব সবজি থাকলেও তেতো কিছু নেই। মা কী করলেন?
বাড়ির পেছন থেকে কালমেঘ পাতা ক’টা ছিঁড়ে দিলেন শুক্তোতে। অনভিজ্ঞ রাঁধুনি সে যাত্রায় সবার হাসিতে সেই সঙ্কট কাটিয়েছিলেন। এই যে ম্যানেজ করার গুণটা আমি মার থেকে পেয়েছি। অবশ্যই গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে আর আমার ম্যানেজ করার আপডেট ঘটেছে!
আমি ছিলাম প্রথম সন্তান। কাকা,পিসি,বাবী,দাদুর প্রশ্রয় থাকলেও মা ভীষন কড়া। একেবারেই পেটা লোহা। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করার অভ্যাস মায়ের থেকে পাওয়া। যেটা আমার রক্তে মিশে আছে। রান্না করতে করতে পড়াতেন। ক্লাস ফোর পর্যন্ত প্রথম হওয়া কেউ আটকাতে পারেনি। কারণ আমার মা। দুপুরে লম্বা একটা মোটা খাতায় একপাতা ইংরেজি আর একপাতা বাংলা হাতের লেখা বাড়ির কাজের সঙ্গে না করলে আর রক্ষে নেই। ক্লাস ফাইভ থেকে খুঁটিয়ে টেক্সট বই পড়ার অভ্যাস মা’র থেকে পেয়েছি। এই অভ্যাসের জন্যই উচ্চশিক্ষার সময় পর্যন্ত কোনদিনই টিউশন পড়তে যাইনি।
মা বলতেন .. নানা বই ঘেঁটে নিজে নোটস তৈরি করতে। এখনকার মতন রেডিমেড নোটস বা প্রফেসর রাখার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। আমি দেখিয়ে দিলে মা সংসারের সব কাজ সেরে আমার জন্য বই থেকে লিখে রাখতেন যা আমার ভীষন কাজে লেগেছিল।
প্রতি বুধবার সকালে কালমেঘের রস খেতে হত। বিকেলে মণিমেলা যেতাম। শরীর চর্চা হোত। মন্দিরের আরতির ঘন্টা বাজার আগেই বাড়ি ফিরে হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসতে হত। অবশ্য তার আগে সংসারের একটা রুটি পরে তিনটে রুটি বেলতে হোত। এটা রুটিবেলা শেখার জন্য। ঘরের খাট আলমারি রোজ নরম কাপড়ে মুছতে হত। এখন যা ডাস্টিং নামে পরিচিত। অবাক হয়ে ভাবি এত নিয়মানুবর্তিতা আমার মা শিখল কী করে!
গুরুজনেরা বাড়ি এলে তাঁদের প্রণাম করা, বড়রা কথা বললে সেখানে না থাকা, বড়দের কথার মাঝে কথা না বলা সব শিখেছি মায়ের থেকে। বলতেন কখনও কাউকে আঘাত দেবে না। হাসিমুখে সব সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করবে। ঈশ্বরে আস্হা রাখবে। সকাল বিকাল ঠাকুর নমস্কার করবে। বড়দের সম্মান জানাবে। নিজেকে সম্মান পাবার, ভালোবাসা পাবার, নিজ সংসারে নিজেকে অপরিহার্য করার দায়িত্ব তোমারই।
কোথা থেকে শিখেছ এসব মা? স্কুল ফাইনালটাও দিতে পারনি। পাঁচ জন দেওরের আবদার মিটিয়েছ। নিজের সব গয়না দিয়ে ছোট ননদের বিয়ে দিয়েছ। বিয়ের পর আমাকে শ্বশুর, শাশুড়ি,দেওর,ননদ,ননদাই, দুই ভাগ্নীকে নিজের করতে শিখিয়েছ। তোমার শিক্ষায় আজ আমার সংসারে, বাইরে সবাইয়ের ভালোবাসা পেয়ে চলেছি। ভাগ্যিস তুমি আমার "মা" ছিলে!! সবাই তাদের সন্তানদের বলে বৌমণির ছেলেমেয়েদের মতো হতে চেষ্টা কর। তুমি সবার বৌমণি। শুধু আমাদের চার ভাইবোনের ‘মা’!
শেষ করি ছোট একটা ঘটনা দিয়ে। আমাদের দু’বোনের বিয়ের পর জামাইষষ্ঠী। উনকোটি চল্লিশ রকমের পদ। সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে গল্পে মশগুল। সব সেরে মা খেতে বসেছে। হঠাৎ আমার নতুন ভগ্নীপতি মায়ের সামনে বসে বলছে... সারাদিন আমাদের এতোকিছু খাওয়ালেন, এবার আপনার খাওয়া দেখি।
মা বেচারা তখন মুখে খড়ে যাওয়া শক্ত একটা লুচির টুকরো ফুলকপি দিয়ে মুখে পুরেছে।না পারছে গালের কাছে আনতে, না পারছে চিবোতে,না পারছে মুখ থেকে বার করতে। মুখ লাল হয়ে সে কি অবস্হা। সবাই টেনে ভগ্নীপতি কে ঘরে আনলাম।
আজ ন বছর তুমি না ফেরার দেশে। তবু তোমার কথা বলে কি শেষ করা যায়!!
🙏 ভালো থেকো আমার মা 🙏