সুপর্ণা ভট্টাচার্য (লেখিকা, নাট্যকর্মী)
বজবজ
আমার মা বড়ো সাধারণ। আমার মা অসাধারণ। আমার মা শীতল। আমার মা বড়ো কঠিন। আমরা যারা বড়ো হতে থাকি মা’কে দেখতে দেখতে,অজান্তেই মাকে জানতে জানতে গড়ে তুলি মায়া মমতার বাসাখানি,তারা হয়ত বড় আবেগী। যে আবেগ স্বতস্ফূর্তভাবে কাঁদায়, হাসায়, নিস্ফল আক্রোশে মাথা কুটে মরে যেতে চায়। আমাদের ছিল নদীর পাড়ে প্রতিবেশীহীন একখানি কোয়ার্টার। বহুবছর পর কয়েক মিটার দূরে একসারি প্রতিবেশী পেয়েছিল আমার মা। তারা হয়ে উঠেছিল আমাদের নির্জন যাপনের আনন্দ স্ফুলিঙ্গ। আমরা পিঠোপিঠি তিন ভাইবোন। আমি বড়ো। সারাটা জীবন ভেবে গেছি, এই সবার বড়ো হওয়াটা আনন্দের না দুঃখের? আদতে আমি কখনও সেই অর্থে বড়ো হতে পারিনি। আমার মায়ের মতোই। মা এই আশির দোরগোড়ায় এসেও শিশুর মতো। একমাত্র বিবাদ হয় বাবার সঙ্গে। আমাদের শাসনও করত নীরবে। সন্ধ্যা ছটার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে সদর দরজা বন্ধ থাকত। বহু অনুরোধের পর খুলত সে দরজা। চীৎকার নয়,গায়ে হাত নয়। শুধু দরজা খুলে ঠাণ্ডা চোখে তাকাত। আমরা ভয় মেশানো লজ্জা পেতাম। মা তেমন করে আলাদা ভাবে তিন ভাইবোনকে আদর দিত না। শুধু সঙ্গে থাকত,সত্য চিনতে শেখাত,মানুষকে ভালোবাসতে শেখাত, তাও বলে বলে নয়,নিজে সেই গুলো করত, অভ্যাসের মতো,আমাদেরও সে অভ্যাস অনায়াসে হয়ে গেছে।একজন সাধারণে অসাধারণ মায়ের আর কীই বা দেওয়ার ছিল!
দেশভাগের সময় ছোটো মেয়েটা পার করেছিল বাংলাদেশের সীমানা। স্বচ্ছল,উচ্ছল জীবন থেকে পড়ে গিয়েছিল অথৈ অনিশ্চয়তার মধ্যে। চিকিৎসক বাবার মেয়ে হয়েও পড়াশোনায় তেমন ডিগ্রি অর্জন করতে পারেনি।বন্ধুর পথে,অভাবের সংসারে মানিয়ে নেবে সে মেয়ে, এটাই স্বাভাবিক। তাই একটু একটু করে বহু বছরের ধৈর্য আর একাগ্রতায় সংসার করে তুলেছে মহিমার,আমার মা।
মা একথালায় ভাত মেখে গ্রাস তুলে দিচ্ছে তিন ভাইবোনের মুখে,পা মেশিনে ফ্রক,সেমিজ,বেনিয়ান বানিয়ে দিচ্ছে,তোলা উনুনের গনগনে আঁচে ফুলকো রুটি সেঁকছে এসব টুকরো ছবি কোলাজের মতো ঘিরে থাকে আজকাল।
বাবার ছিল তাসের আড্ডা। অফিস শেষে,টিউশন করে,আড্ডা দিয়ে মাঝেমধ্যে ফিরতে রাত করত। মা রাতের কাজ সব সারা হলে গল্পের বই নিয়ে বসত। বাবার জন্য অপেক্ষায় অধৈর্য থাকত না। আমাদেরও সেই বই পড়ার নেশা ছড়িয়ে গিয়েছিল, রাতে ঘুম আসার আগে বই থাকত আমাদের হাতে, গল্পের। আজ নিভে আসা দৃষ্টিতেও মা বই পড়ে। আমরা তিন ভাইবোনেরাও আজ আশ্রয় পাই বইয়ের কাছেই। আমরা তিনজনের কেউ খ্যাত নই, কিন্তু মায়ের চোখের আলোয় আলোকিত। এ আমাদের গর্বের।
আমাদের তিন ভাই বোনের সাংস্কৃতিক চর্চায় প্রচ্ছন্ন সায় থাকত মায়ের। অভিনয় করায়, আবৃত্তি,ছবি আঁকায়,বোনের গান শেখায় মায়ের দিক থেকে কখনও বাধা আসেনি। তখন তো, এখনকার মতো সময় ছিল না। মধ্যবিত্তর টানাটানির সংসারে আমরা এ সমস্ত কিছু কেমন নিজে নিজেই,আপন ইচ্ছায় করেছি। মায়ের কাছে সেলাই শিখেছি, উল বোনা, ক্রুশ কাঠিতে বোনা, বিভিন্ন স্টিচ,পা মেশিন চালানো। আমি তো সেলাই স্কুলেও যেতাম, কাটিং শিখতে। মনে রেখো, তখন ইউটিউব ছিল না। মায়েরাই ছিল শিক্ষক।
যেদিন মায়ের ঘরের চৌকাঠ পার করে, চলে এলাম এক সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে, প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যেই ভাসত কানে মায়ের গলা, 'সিঁদুর পরে কী অপূর্ব দেখাচ্ছে তোকে'- সিঁদুর পরা আমাকে মনে হয় অন্যরকম লেগেছিল মায়ের।
একটু একটু করে সত্যিই অন্যরকম হয়ে গেছি এত বছরে, বদলে গেছি,আজকের আমি, মা জানতে পারে না।
আমার এলোমেলো ভাবনা ছাপার অক্ষরে দেখলে সব থেকে খুশি হয় মা, এখনও মঞ্চে দেখলে সবথেকে বেশি আনন্দ পায় মা, আমার মা।
হলুদ বর্ণ চাঁদ ওঠে যখন আকাশে, এক একদিন চাঁদের দিকে তাকালেই তোমার মুখ দেখতে পাই। তোমাদের নির্জন ফ্ল্যাটের বারান্দায়।
রোজ তোমার ফোন আসে নিয়ম করে, আমি ভুলে যাই, তুমি ভোলো না, আমি যে তখন মা হয়ে ছেলের টিফিন বানাই। তোমার এখন অবসর অনেক, কোমরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে আগুন তাতে ওম নিতে হয় না। শুধু শূন্য ঘরে ওম খুঁজে বেড়াও আমাদের শরীরের। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাও ফোন করার সময়টুকু আসবে কখন! আমাদের গলার স্বর শুনবে কখন!
তারপর বেলা গড়ালে আনমনে ভাত বাড়ো বাবার। ছোট্ট থালায় ভাত খাও। স্বাদহীন ঝোল।বাবার তেল মশলা খাওয়া বারণ। তাই তুমিও তেমনটিই খাও। চাটনি খেতে গিয়ে মনে পড়ে আমার কথা। বিছানায় শুয়ে বোনের কথা। রাতের বেলা কোমরে ব্যথা করলে ভায়ের কথা। নাতিরা গেলে তাদের মুখে আমাদের শিশুবেলা খুঁজতে থাকো।
আমরা বড়ো হইনি মা গো। এখনও কোল খুঁজি তোমার। এখনো আঙুল ধরতে চাই। আমাদের সন্তানরা যতবার মা বলে ডাকে, ততবার আমরা ডেকে নিই তোমাকে।
আমাদের মা’কে।