বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতা উড়তে থাকে বাদলা হাওয়ায়

চিন্ময় মুখোপাধ্যায়, হাওড়া

আমাদের সকলের কাছেই কিছু সংলাপ রয়েছে, আকাশের ওয়ালপেপারটা যখন একটু একটু আবছায়া হতে থাকে,যখন গাভীর মতো পূর্ণা কাজলা মেঘ ঢুকতে থাকে অবিরাম, বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতা উড়তে থাকে বাদলা হাওয়ায়....মরচে ধরা রেডিওয় বাজে --


"আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।"


এই হয়তো বা বর্ষার সংলাপ। আমাদের আত্মগত সংলাপও বাজতে থাকে, বাজতেই থাকে।আসলে মনখারাপের কোনো ডিলিট অপশন নেই, একমাত্র ওটাই হয়তো বাই ডিফল্ট, তাই বাইরের আকাশে মেঘ জমলেই মনের ঘাসজমিতে ভেজা সজল পায়ের চারণা। চায়ের সঙ্গে যেমন পেয়ালা মানায়,কফির সঙ্গে মাগ.... ঠিক সেরকমই বৃষ্টির সঙ্গে মনখারাপ,বিষাদ....

rain painting


মেঘের পরে মেঘ জমে আর পুরোনো স্মৃতির দোতলা বারান্দা থেকে আমরা এসে বসি জানালার ধারে। -- সোঁদা গন্ধ,লাল ইঁট,শ্যাওলা আর কবেকার স্যঁতাপড়া স্মৃতি -- বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে আর একচিলতে তেল ঝুলকালি মাখা রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসে কয়লার উনুনে মা রান্না করছে,একটু দূরে বসে চা শেষ করে বিড়ি ধরিয়েছে বড়োমামা, গল্প চলছে এমনি কোনো বর্ষার দিনে কয়েকটি কিশোর-কিশোরী পোলো জাল নিয়ে আদিগন্ত মাঠে হাঁটুজল কাদা ভেঙ্গে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে ঢাকা-মুণ্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের বর্ষায়। কিভাবে টানা বর্ষায় পুকুর-ডোবা-খাল-বিল ভেসে যায়, কিভাবে কইমাছ উঠে আসে গেরস্ত উঠোনে --এমনি সব গল্প শুনছি হাঁ করে বসে।


বর্ষার কোনো দেশ নেই, সীমান্ত নেই, ইমিগ্রেশন খাতা নেই। তাই পুববাংলার মন্থর মেঘে এসে মেশে পশ্চিমের উদ্ভিন্নযৌবনা চপলা মেঘ, একবেলার বৃষ্টিতে কলেজস্ট্রিট, ঠনঠনিয়া ডুবে যায়,প্রথম চুম্বনসিক্ত যুবতী হাল ফ্যাশানের ছাতা সামলে মফঃস্বলের ট্রেন ধরে। শহরের সংলাপ আউড়ে চলে কাকভেজা উন্মাদ, আকাশের সঙ্গে তার অনন্ত বালখিল্য। শহরের বর্ষা বায়োস্কোপের মতো, সবকিছুই তার বড্ডো মাপা, তিলমাত্র এদিক ওদিক হওয়ার যো নেই, আর গাঁ-গঞ্জের আষাঢ় অ্যামেচার যাত্রাপালার মতো,তিনদিক খোলা তার মঞ্চ, সেখানে সংলাপের ধরতাই ফস্কে যায় হামেশাই। আসলে শহরের তো কোনো দিকচক্রবাল নেই,আছে জ্যামিতির কাটাকুটি।


আষাঢ় সন্ধ্যে নামছে, ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে একটানা,সেও যেন মহাকালের অনন্ত সংলাপ,জল ছপছপ করে মেঘভাঙ্গা চাঁদ ঢুকছে কলোনীতে, নবীন বৈরাগী মাটির দাওয়ায় বসে মঞ্জীরা বাজিয়ে গান গাইছে,সদ্য অষ্টাদশী বউটি হ্যারিকেনের আলোয় সূঁচ-সুতো দিয়ে প্রিয় নাম লিখছে চটের আসনে -- যে নামের মানুষটি কাজের অজুহাতে আজ দুই বর্ষা হল ঘরে ফেরেনি। উঠোনে চাঁপা ফুলের বিষাদ গন্ধ ভাসছে নীরব সংলাপের মতো,একটা লক্ষীপেঁচা মাঝে মাঝে ডাকছে ঝুম গাছতলায়, নিঃসঙ্গ একটা হাওয়া বিষাদ বিলি করে বেড়াচ্ছে বুনোফুলের ঝোপে,মাধবীলতায়, অশ্বত্থের ঝুপসি অন্ধকারে।


আমাদের জীবনেও এমনি একেকটা আষাঢ়-শ্রাবণ থাকে, এমনিতে বোঝা যায় না, কিন্তু দৃশ্যপট বদলে বদলে কী এক বিষাদ মুহূর্তে মেঘ করে আসে, মনের ভেতর থেকে কায়াহীন সংলাপ বুড়বুড়ি কাটে,অথচ বাইরের মানুষটা নিভে আসে, ভিড়ের মাঝখানে হঠাৎ একা হয়ে যায়,সে বুঝতে পারে আবহাওয়ার পূর্বাভাস,মেঘ ঢুকছে শহরে,বিরহী যক্ষের বর্ষা আসছে,নিভৃতে বাজছে অনন্ত সংলাপ........

"আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং........"

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...