সোমশ্রী অধিকারী, ব্যারাকপুর
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে.....
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে অলকাপুরী থেকে নির্বাসিত বিরহী যক্ষ রামগিরি পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া এক মেঘকে দেখে তার বিরহিনী প্রেয়সীর কাছে বার্তা পৌঁছে দেবার কাতর অনুনয় জানিয়েছিল। তাই বর্ষা মানেই যেন বিরহ।
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়”
তীব্র গরমে মানুষ যখন ক্লান্ত, অবসন্ন তখন 'রিমঝিম গিরে শাওন' আর কদম ফুলের স্নিগ্ধ সুগন্ধে একরাশ সজীবতা নিয়ে বর্ষা এসে হাজির হয়। মেঘমল্লার আর দেশ-এর হাত ধরে বর্ষা বাজিয়ে চলে তার রাগিনী।
“শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে
বুকের পরে”
বৃষ্টি আসছে শুনলেই ছেলেবেলা এসে গলা জড়িয়ে ধরে , মেয়েবেলার আদুরে আবদারে স্মৃতি এসে কড়া নাড়ে। নবীন মেঘের সুর লাগে মনে প্রাণে; বৃষ্টির সোঁদা গন্ধে আমরাও ভিজে উঠি।
বর্ষাকাল মানে আমার চোখে এখনও সেই ছেলেবেলা ভেসে ওঠে। খুব বৃষ্টি হলে আমাদের বাড়ির বারান্দা জলে ভরে যেত আর আমরা ছোটরা সবাই মিলে কাগজের নৌকা ভাসাতাম। পাশের মাঠে পিছনের পুকুর উপচে জল আসত আর কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যাওয়া সেই মাঠে কত মাছরাঙা, বক যে এসে সেখানে বাসা বাঁধত তার হিসেব ছিল না।
বর্ষাকাল মানে আমার কাছে গঙ্গার জল প্রাইমারি স্কুলের পাঁচিলের গর্ত দিয়ে ভিতরে এসে ঢোকা আর ছুটির পর আমাদের জুতো মোজা হাতে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে রাজাবাবুর মিষ্টির দোকানের বেঞ্চে বসে পড়া। বর্ষা মানে, স্কুলের পাশের গাছ থেকে অমিতাভ, সৌম্য, কৌশিক, অয়ন, গোপা আর আমি ঢিল মেরে কদম ফুল পাড়তে গিয়ে কুমোরের মাটির টব ভেঙে ফেলে কান ধরে টিফিনের সময় দাঁড়িয়ে থাকা।
ভোলানন্দগিরি আশ্রমের অনাথ বন্ধুদের সঙ্গে ছাতা থাকা সত্বেও, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরা আর তুমুল বকা খাওয়া। প্রশান্ত, রমেশদের অসহায়তা দেখে কিছু করতে না পারার কষ্ট কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা।
আজ জানিনা সবাই কোথায় আছে, কিন্তু, বর্ষাকাল এলে আমার নাছোড়বান্দা জেদের কাছে হেরে যাওয়া ওদের করুণ মুখগুলো বড়ো মনে পড়ে.... “সোমশ্রী তুই ভিজিস না...তাহলে বাড়িতে খুব বকা খাবি...আরে আমরা তো বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসি।”
বর্ষাকাল মানে গঙ্গার লাল হয়ে যাওয়া জলে ইলিশ মাছের আনাগোনা, আর মা অফিস থেকে ফেরার পথে গঙ্গার টাটকা ইলিশ অর্ধেক ভাগ করে নিয়ে আসা। ফ্রীজ না থাকায় রাত্রে হ্যারিকেনের আলোয় রান্না করা ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া। সেসব দিনের স্মৃতি এখনও অমলিন আমার কাছে। এখন ইলিশ মাছ খেলেও সেই স্বাদ যেন আর পাই না। তবে আমার বর্ষাকাল সবসময় কিন্তু সুখ-স্মৃতি নিয়ে আসেনি।
ভরা শ্রাবণের অঝোর ধারায় বৃষ্টি দেখলে, আমার মনে পড়ে বাবার কাঁধে চড়ে প্রথম কলকাতায় রাস্তায় জলের স্রোত দেখা। তবে সে সময় কলকাতায় জল জমত অনেক বেশি, আর তার সঙ্গে ছিল খোলা ম্যানহোলের ভয়ঙ্কর বিভীষিকা।
আমরা সেদিন যাচ্ছিলাম ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে; বাবার মেজ মামার বাড়িতে। সেইসময় ব্যারাকপুর থেকে এসপ্ল্যানেড আসত L - 20 নম্বরের একটি দোতলা বাস। সেই বাস থেকে নেমে আমরা আরেকটি বাস ধরলাম বউবাজার যাব বলে।
সেটা বউবাজার আসার আগেই আচমকা বন্ধ হয়ে গেল জলের তীব্র স্রোতে। আমরা নেমে পড়তে বাধ্য হলাম। তারপর বাবা আমাকে কাঁধে তুলে নিলেন। তখন আমি এতটাই ছোট যে সেই জল প্রায় আমার বুক ছুঁয়েছিল, আর বাবার কোমর। আর দেখেছিলাম কলকাতার দোকানদারদের সহৃদয় মানবিকতার মুখ। তারা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পথচারীকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে কোথায় কোথায় ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা।
আরেকটা বৃষ্টির দিন আমাকে কলকাতায় বর্ষাকালের আতঙ্ককে আজও ভুলতে দেয় না। আমি তখন সদ্য কলেজস্ট্রীট ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়েছি স্নাতকোত্তরে।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার, আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বিমলবাবু; শ্রদ্ধেয় বিমল মুখোপাধ্যায়।
উনি এসে জানালেন, কবি শামসুর রহমান বাংলাদেশ থেকে আমাদের এখানে আসছেন সেমিনারে। বাংলা সাহিত্য নিয়ে কিছু মূল্যবান মতামত দেবেন বলে।
সেদিন যখন আমরা অপেক্ষা করছি আচমকা আকাশ জুড়ে বৃষ্টি এল। তার সঙ্গে মেঘের ভয়ানক গর্জন। সেই বৃষ্টিতে কলকাতা কখন যে বর্ষার নদীর মত হয়ে উঠল, আমরা আমাদের ক্লাসে বসে বুঝতেই পারিনি।
আমরা চার বন্ধু মিলে হাত ধরাধরি করে সেই কোমর জল পার হয়ে যত শিয়ালদা স্টেশনের দিকে এগোচ্ছি, ততো কলকাতা দুষ্টুমি করে নদী থেকে সাগর হয়ে যাচ্ছে।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ট্রেনে করে কীভাবে যে ব্যারাকপুরে এসে পৌঁছেছিলাম, তা আজও বিভীষিকা মনে হয়।
আর একটা কথা না বললেই নয়, সেটা হল আমাদের সময় বর্ষাকালে প্রেমের রূপ ছিল অনন্য।
অঝোর বৃষ্টিতে প্রেমিক-প্রেমিকাকে তাদের প্রিয় বা প্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যেত ছাতা নিয়ে। তীব্র বৃষ্টি, মেঘের গর্জন উপেক্ষা করেও তারা দাঁড়িয়ে থাকত প্রিয় বা প্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হবে বলে এবং তাকে দেখার পর তাদের মুখের সেই অমলিন হাসি আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না। আজ প্রেম আবদ্ধ ক্যাফে কফি ডে অথবা মহার্ঘ রেস্তোরাঁর কাচের দেওয়ালে বন্দী ঘরে।
বর্ষার কাছ থেকে আমি পেয়েছি অনেক কিছু। আমার ছেলেবেলা, আমার মেয়েবেলা, আমার যৌবন, আমার কবিতা, আমার গান, বর্ষা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে সবটুকু! কিন্তু আজ এই চল্লিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে এখনও বড় বলতে ইচ্ছা হয়...
মগর মুঝকো লৌটা দো
বচপন কা শাওন
উহ কাগজ কি কশতি
উহ বারিষ কা পানি।