বাইসনের পালের মতো একটা বড় মেঘের দলের দখলে তখন রাস্তা!

গৌরব রায়,  কৃষ্ণনগর, নদীয়া 

সচরাচর বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষার রূপ উচ্ছল তরুণীর মতো। তার আগমনে প্রকৃতি হয়ে ওঠে সুজলা সুফলা শ্যামলা। বড়ই মনোরম সেইরূপ, দেশের একটা বড় অংশে এই রূপেরই ছায়া থাকে। কিন্তু আজকে আমি এই অপরূপা বর্ষার রূপের বর্ণনা লিখতে বসিনি। আজ আমি এমন একটা বর্ষার গল্প বলব যা চেনা-জানা বর্ষার চেয়ে অনেকটাই আলাদা।

   পেশাসূত্রে একবার আমায় উত্তর-পূর্বের এমন এক জায়গায় যেতে হল, যেখানে শীত প্রায় আসবে আসবে করছে। মণিপুরের পাহাড়ী তাপমাত্রা আমার জানা, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই নিচে থাকে সারা বছর। শীতকালে তাপমাত্রা শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়, দোসর বৃষ্টি।

 হিমালয়ের পূর্ব প্রান্তে প্রত্যন্ত জেলা শহরে শুরু হল আমার দিনযাপন ।

তাঙ্ক্ষুল নাগা অধ্যুষিত এই অঞ্চল প্রথম দেখায় পান্ডব বর্জিত মনে হতে পারে। প্রকৃতির নিবিড় কোল বলতে যা বোঝায়, একেবারে নির্ভেজাল সেই জিনিস।

gourab-1

  একটা পাহাড়ের মাথার ওপর সদর বাজার।  ঢাল বেয়ে তরতরিয়ে নেমে গেলে একটা একটা গ্রাম। গ্রাম না বলে, তাদের অবশ্য পাড়া বলাই ভাল। পৌঁছবার পথ মাটি পাথরে বন্ধুর। গাড়ি দুরস্ত। নিরামিষ সাইকেলটিও সে পথে বেপথু হবে। বিশেষ কাজে আসবেনা, কিন্তু থমকে যাবে চোখ। আটকে যাবে পা। প্রকৃতি উজাড় করে সাজিয়ে রেখেছে ভাঙা পথের দু’ধার।

নানা রকমের নাম না জানা নীল ফুল তার বুনো গন্ধের পসরা সাজিয়ে রেখেছে।

এমন আদিম বিপদসংকুল অরণ্যে বৃষ্টি নামে আপন খেয়ালে।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বৃষ্টিপাত এমনিতেই এই অঞ্চলে একটু বেশি। তবে এই অচিন পাহাড়ী প্রান্তে তার রূপ আলাদা। অচেনা।

gourab-5

  সারা বছর বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় উপত্যকা। কখনও হালকা কখনও মাঝারি। বর্ষায় ভারী থেকে অতি ভারী।

ভিজে ভিজে অভ্যস্ত এখানের মানুষরা। তাই বৃষ্টি ততটা গায়ে মাখেন না। সেটা নিয়ে চিন্তা করেও বিশেষ সুবিধা হবে না ভেবে ভাবা ছেড়ে দিয়েছেন মনে হয়। কিন্তু আমি তো সে দেশে অর্বাচীন, তাই যাই দেখি সব-ই নতুন লাগে চোখে।

 একদিনের গল্প বলি।

সেদিন আমার কাজকর্ম সারতে বেলা পড়ন্ত হয়ে এল। হঠাৎ খেয়াল হলে পাহাড়ের ছায়াটা যেন গাঢ় হয়ে ঘনিয়ে উঠছে চারদিকে। চারদিক আবছায়ার আড়ালে। রাস্তায় হাঁটছিলাম। আলো এমন বদলে বদলে যাচ্ছিল যে অনুভব করলাম ঘোলাটে ভাবটা ক্রমশও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে যেন। রাস্তা পাহাড় ঢেকে দিচ্ছে। বাইসনের পালের মতো একটা বড় মেঘের দল দখল করে নিয়েছে রাস্তা।

gourab-2

আমার কাজের দপ্তর থেকে থাকার জায়গাটা খুব বেশি হলে দুই কিলোমিটার হাঁটা পথ। তারপর নামতে হয় উতরাই ধরে। আধঘন্টার মতো সময় লাগে। এই মেঘ-বৃষ্টির ব্যাপারটা কিন্তু একেবারেই আলাদা।

বৃষ্টির জলের ফোঁটা সরাসরি মাটিতে না নেমে অনুভূমিক উড়ে আসছে হাওয়ায়। বিন্দু বিন্দু জমা হচ্ছে মুখের উপর।

gourab-4

ততক্ষণে মেঘের চাদর এতটাই পুরু হয়ে উঠেছে যে একহাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। আচমকা মনে হল, গোটা পৃথিবীতে একা আমি। চারপাশটা ঢেকে গিয়েছে ধ্যানমগ্ন নিঃশব্দ কোন ঋষির জটাজালে।

gourab-3

কত অজানা কত অবচেতনকে চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাওয়া সেই বর্ষা। তিরিশ মিনিটের পথ সেদিন দেড় ঘন্টা লেগেছিল বটে, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা সারা জীবনের।

বুনো নীল ফুলের গন্ধ মাখা সদ্যস্নাত মাটির রাস্তাটা যখন ধরেছি নীল আকাশ তখন সন্ধ্যের আঁধারে কালো।  একটা-দুটো তারাও দেখা যাচ্ছে। তাল মিলিয়ে সামনের পাহাড়টায় বাল্বের আলো জ্বলে উঠছে একের পর এক।

 চঞ্চলা চপলা তরুণী বর্ষা নয় সেই বৃষ্টি যেন মৌনি তাপসের রূপ ধরে এসেছিল সেই বিকেলে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...