তন্ময় দে (শিক্ষক)
ট্যাংরা কলোনি হাইস্কুল, বনগাঁ
'বাজল ছুটির ঘন্টা' আজ যতো না আনন্দ বয়ে আনে তার থেকেও যেন বিতর্কের হুজুগটা বেশি থাকে।
ছুটি শব্দটা শুনলেই আমাদের সবার মনে নানারকম ছবি তৈরি হতে থাকে। তবে সেই ছবির অনেকটা জুড়েই থাকে স্কুল আর স্কুলবেলার গল্প। স্কুল জীবনের প্রতিদিনের ছুটির ঘন্টা বা দীর্ঘ অবকাশের ছুটির ঘন্টা নতুন নতুন খুশি এনে হাজির করে। সেই খুশিতে যেমন মিশে থাকে টিফিন পিরিয়ড-হজমি-আলু কাবলি-আচারের গন্ধ , তেমনি স্কুল ফেলার পথে কারও আড় চোখে তাকানোর প্রত্যুত্তরে মিষ্টি হাসি-অপেক্ষার বাস মিস ইত্যাদিও থাকে। কর্মজীবনে প্রবেশের পর বুঝলাম ছুটিটা শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীদের কাছে অন্যরকম বিষয়। এখানে ছাত্রছাত্রীদের মতো আমাদেরও ছুটি হয় রোজ কিংবা দীর্ঘ অবকাশ এর শুরুতে। রোজের ছুটি মানে বাড়ি ফেরা নিজের কাজকর্ম পারিবারিক জীবন আর দীর্ঘ অবকাশ মানে কোথাও নিজের মতো একটু ঘুরতে যাওয়া বা ব্যক্তিগত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। গত কয়েক বছর ধরেই অবশ্য ছুটি নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেশ কয়েকবছর ধরেই পরিবেশের খেয়ালি আচরণে স্কুলের ছুটির তালিকা এলোমেলো হচ্ছে। এরই মাঝে আমরা একটা অতিমারীর পর্ব পার হচ্ছি। তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে প্রায় দুটি শিক্ষাবর্ষে স্কুলের পড়াশুনা ভালো করে বলতে গেলে শ্রেণিকক্ষে পড়াশুনা কিচ্ছুটি হয়নি। কোথাও ফোন ইত্যাদি সহযোগে অনলাইন অনলাইন নামক হুজুগের কিছু ক্লাস হলেও সবাই সেই সুযোগ নিতে পারেনি আর যারা নিতে পেরেছে তাদের একটা অংশ মাঝখান থেকে মোবাইলে বুঁদ হয়ে যাওয়ার মতো মারাত্মক একটা নেশাতে আসক্ত হয়ে গিয়েছে হঠাৎই।
এরই মাঝে ছুটির ঘন্টা রোজ বাজে। জানি বাড়ি ফিরেই লেসন প্ল্যান বা পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরিতে সময় দিতে হবে। তারওপর মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষার হলে একটানা বিরক্তিকর ইনভিজিলেশন ডিউটি দিতে না দিতেই সেই পরীক্ষার খাতা দূর-দুরান্ত থেকে নিয়ে আসা। আর রোজের ৫-৬ টা ৪০/৪৫ মিনিটের ক্লাস সামলে যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় সেইসব খাতার যথাসম্ভব নিখুঁত মূল্যায়ন,স্ক্রুটিনি করে দেওয়ার ঝক্কি। সেইসঙ্গে বিদ্যালয়ের পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন পর্ব উতরে দিয়ে তার খাতা দেখা-চলতেই থাকে। একই সঙ্গে মার্চ-মে প্রায় প্রতিবছরই থাকে নির্বাচন। নির্বাচনের সবথেকে কঠিন ডিউটি অচেনা অজানা পরিবেশে বুথে গিয়ে ভোট নিয়ে তা ঠিকঠাক ভাবে ডিসিআরসিতে জমা দেওয়া।ফলে এই সময়টায় রোজ বাড়ি ফিরে সাময়িক অবকাশ বা সাপ্তাহিক-পরবের ছুটি সবটাই আমাদের কাছে কার্যত হয়ে দাঁড়ায় সেই বিজ্ঞাপন খ্যাত ট্যাগলাইন-'তোমার ছুটি,আমার ছুটি নয়' এর মতো। আবার মে মাসের গরমের ছুটির মাঝেই মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের রেওয়াজ চলছে কয়েক দশক ধরে। এমনও হয়েছে বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মী ওই সময়ের দীর্ঘ অবকাশে বহু হিসেব নিকেশ করে চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্য বহু আগে কেটে রাখা ট্রেন টিকিট, হোটেল বুকিং বাতিল করেছেন বা মাঝপথেই যাত্রা বাতিল করে ফেরত এসেছেন স্কুলের পড়ুয়াদের হাতে ফলাফল পৌঁছে দিতে। গোটা বছরে অধিকাংশ রবিবার গুলোতে প্রাথমিক শিক্ষকদের একটা বড়ো অংশ নির্বাচনী কাজকর্ম সামলাতে বাধ্য হন বুথ লেভেল অফিসার নামক গালভরা পদের হাজার ঝক্কি সামলাতে। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখা বা নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের মতো কাজে খুব সামান্য একটা অর্থ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ শিক্ষক ওই অর্থের জন্য নয়, বরং নিয়ম পালন বা কর্মজীবনের ঝঞ্ঝাট এড়াতে কাজগুলো করতে বাধ্য হন। এখনও গাঁ-গঞ্জে-শহরতলিতে স্কুল মাস্টার -দিদিমণিরা আম জনতার চোখে চোখে থাকেন।
তার একটা কারণ যদি তথাকথিত লাখ লাখ বেতন পাওয়ার মিথ হয় অন্যটা হচ্ছে মাস্টারদের বছরে দুমাস ছুটিতে ফ্রি বেতন নেওয়ার মিথ। বলার অপেক্ষা রাখে না-দুটোই অশ্বত্থামা ইতি কুঞ্জর-এর মতো অর্ধ সত্য। বলতে গেলে লাখখানেক টাকার বেতন মূলতঃ হাইস্কুলের উচ্চতর স্কেলে কর্মরত শিক্ষকদের একাংশ দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের একদম শেষ দু-একবছরে পেয়ে থাকেন। আর ছুটি একটানা পাওনার গল্পও অর্ধ সত্যই। গোটা শিক্ষাবর্ষে গরম-উৎসব ও অন্যান্য পর্ব মিলিয়ে এখন বরাদ্দ মোট ছুটি ৬৫ দিন। ফলে একটানা দু সপ্তাহের বেশি ছুটি তেমন মেলে না এক দুর্গাপুজোর সময় ছাড়া। ওই ছুটি আজকাল রাজ্য সরকারের প্রায় সব দফতরের কর্মীরাই পেয়ে থাকেন। এবছর শোনা যাচ্ছে গরমের ছুটিতে সামার প্রজেক্ট থাকবে। সেখানে পড়ুয়াদের নানান কাজে সামিল করতে হবে। কোথাও পাড়াভিত্তিক কোনও প্রকল্প কোথাও বা গঞ্জ বাজার ব্লকের বিভিন্ন দোকান-অফিস-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘুরে তাদের সেইসব প্রতিষ্ঠানের নানা দিক নিয়ে শিখন কর্ম সমাধার প্রয়াস জারি রাখতে হবে প্রখর গরমের তপ্ত দুপুরে গাঁ-গঞ্জ-মফস্বল-নগরীর অলি গলি মহল্লা ঘুরে ঘুরে। আজকের দিনে আমরা সরকার নিযুক্ত আজ্ঞাবহ কর্মী মাত্র। তাই সিলেবাস পরীক্ষা পদ্ধতি বইপত্তর,পোশাক আশাক,যানবাহন,দুপুরের খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি কোনও বিষয়ের নিয়ন্ত্রণে শিক্ষক কুলের খুব একটা ভূমিকা আজ আর নেই। অথচ ছুটি নিয়ে সরকারি ঘোষণা হলেই চারদিকে বেশ একটা শোরগোল পড়ে যায়।
সেখান থেকে যে সারমর্ম উদ্ধার হয়- তাতে মনে হয় ছুটি পাওয়া দোষের আর সেই দোষের একমাত্র ভাগীদার বঙ্গের শিক্ষক সমাজ। অথচ ছুটির নিয়ন্তা সরকার। আর স্কুলের ছুটি কিন্তু শিক্ষকদের উদ্দেশে ঘোষিত হয় না, মূলতঃ পড়ুয়াদের সুবিধার্থে ছুটি ঘোষিত হয়। গরমকালে বা বর্ষায় গাঁ-গঞ্জে জলকষ্ট -বিদুৎ বিভ্রাট-পথঘাটের দুরবস্থায় স্কুল চালানো মুশকিল হয়ে পড়ে। প্রখর গরমে বাঁকুড়া শহরে হয়তো হয়তো স্কুল চালানো যায় কিন্তু একই জেলার এ প্রত্যন্ত গ্রামে জলকষ্ট বা বেহাল বিদ্যুতের কারণে স্কুলের পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঘটে। ঘোর বর্ষার দিনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুর শহরে হয়তো স্কুল চালাতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয় কিন্তু ওই একই সময়ে একই জেলার গোসাবার কোন গ্রামে সাপের উপদ্রবে রাস্তা চলাচল পণ্ড হতে থাকায় স্কুল চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
স্মরণকালে এমন ছুটির আদেশনামাও বঙ্গবাসী দেখেছে যেখানে স্কুল ছুটির কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের যেতে হয়নি কিন্তু মাস্টারমশাই-দিদিমণি-শিক্ষাকর্মীদের স্কুলে গিয়ে সাড়ে দশটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত থাকতে হয়েছে। অথচ শিক্ষকদের প্রধান কাজ স্কুলে পড়ানো যদিও সঙ্গে অন্যান্য কাজও করতে হয়। কিন্তু ছাত্রই যদি না থাকে তাহলে সারাদিন ধরে বসে থাকা তাদের কাছে পন্ডশ্রম ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেকারণে ছুটিগুলো এলাকাভেদে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন সময়ে যাতে দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
প্রাকৃত ছুঢ শব্দ থেকে হিন্দি ছুট শব্দের কল্যাণে বাংলায় ছুটি শব্দের আবির্ভাব। রবি ঠাকুরের ছুটি নিয়ে অনেক কবিতা গল্প গান যেমন বাঙালির কাছে ছুটি শব্দটাকে নস্টালজিক করে তুলেছে তেমনই এযুগের মিডিয়া বা লোকমুখের মিথে শিক্ষককুলের ছুটিভাগ্য ঈর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তাই একালের গায়কের কন্ঠে ছুটির ঘন্টা বাজার গানের সুরে গুনগুন করতে করতে মাস্টারমশাই দিদিমণিদের ছুটি পাওয়ার হিসাব করতে বসলে কিন্তু ছোট হয়ে আসা পেন্সিলই শুধু হাতে থাকতে পারে।