শুভ্র চট্টোপাধ্যায় (শিক্ষক)
হার্ভার্ড হাউস হাই স্কুল, ট্যাংরা রোড, কলকাতা
জিয়ো বাংলা ওয়েব পোর্টালের পক্ষ থেকে আমার ওপর হঠাৎ করেই হুকুম জারি হয়েছে যে আমি যেন মাস্টারমশাইদের ‘গরমের ছুটি’ নিয়ে কিছু লিখি। কিন্তু না-লিখতে পারলে শাস্তি কী হবে, তা অবশ্য কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট করেননি। ফলে, তড়িঘড়ি ক’রে লিখতে বসতে হল।
হুকুম তো জারি হল। কিন্তু লিখতে গিয়ে আরেক আশঙ্কায় বুক দুরুদুরু করতে লাগল— ‘পাছে লোকে কিছু বলে’।
একে তো বৈশাখের ঝাঁঝালো রোদ আর চাঁদিফাটা গরম, তার ওপর যদি মাস্টারমশাইদের ‘ছুটি’ নিয়ে কিছু লিখি, গণদেবতা কি ক্ষমা করবে আমায়? পড়ে হয়তো হিট স্ট্রোক হবে। শেষে কি আমার ফাঁসি-ই ভবিতব্য!
বিশ্বাস করুন, জীবনের এই পর্যন্ত এসেও ইচ্ছকৃত কোনো প্রাণী হত্যা করিনি এখনো। অবশ্য অগুনতি মশা মেরেছি; কারণ তাদের আমি দৈত্য-দানবদের প্রেরিত চর বলেই মনেকরি। তা বলে, অন্য কোনো প্রাণী! নৈব নৈব চ। মাংসের দোকানে গিয়ে কতটা নেব, তা বলে দিয়েই পেছন ঘুরে দাঁড়াই। সময় বেশি লাগলে পাশের কোনো চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেয়ে আসি। এমনই অহিংস আমি। সেই আমি কিনা মানুষ খুনের দায়ে জেলে যাব! প্রতিদিন তো গাছ-পাঁঠা কিনতে পারিনা, তাই সপ্তাহান্তে মাছ-পাঁঠাই সম্বল। এতেও যদি কারো অম্বল হয়, তাহলে জেলোসিল নিয়ে ঘোরার দায় কি আমার? আপনারা ভাবছেন, কী কথায় কী কথা আসছে। আরেকটু খুলেই বলি, আমার চাকরি, আমার হকের ছুটি, তাতে যদি অন্য কারো গাত্রদাহ হয়, তার জন্য কি আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে? এতো কমলাভোগ নয়, যে নাম শুনেই রসনায় দোল দেবে। ভয় তো লাগে বলুন, খারাপ লাগার কথা না-হয় বাদ-ই দিলাম।
‘গরমের ছুটি’ পাওয়ার অভ্যেসটা আর সকলের মতো আমারও সেই স্কুল জীবন থেকেই। মে মাস পড়লেই আমাদের গরমের ছুটি শুরু হতো। চলত প্রায় এক মাস। অবশ্য ছুটিটা যত দীর্ঘ শোনাচ্ছে, বাস্তবে সেটা তত দীর্ঘ হতো না। ছুটিতে পিসির বাড়ি, মাসির বাড়ি করতে গিয়ে বেশ কিছুদিন যেত। তারপর বাড়ি এসেই সর্দিজ্বর। সেইসঙ্গে মায়ের বকুনি, বাবার হিটলারি চাহনি, সেসব মিলে ছুটি প্রায় নিবুনিবু হয়ে আসত। হাতে যে ক’টা দিন থাকত জান বাজি রেখে স্কুলের দেওয়া ‘গরমের ছুটিতে বাড়ির কাজ’ করতে-করতে তেল শেষ হয়ে যাওয়া প্রদীপের মতো ছুটি-টা একবার দপ করে উঠেই তারপর নিভে যেত। তারপর স্কুলে ছুটির কাজের খাতা জমা দিয়ে তা ফেরত নেওয়ার সময় খাতায় একেবারে রক্তারক্তি কান্ড! ফল স্বরূপ, স্কুলে মাস্টারমশাইদের পিনালকোড মেনে শাস্তি, আর বাড়িতে মায়ের মার— এই দুইয়ে মিলে ছাত্রজীবনের ওপর একেবারে ঘেন্না চলে এসেছিল।
কিন্তু, দিন কাহারো সমান নাহি যায়। যে ছেলেটি এতোদিন ছাত্রের ভূমিকায় অভিনয় করত, আজ সে মাস্টারমশাইয়ের রোল করছে। চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনয়টাও অনেকটা বদলেছে। তবে, গরমের ছুটি পাওয়ার আনন্দটা এখনো একইরকম। অবশ্য, সে আনন্দটা আর সকলের সঙ্গে ভাগ ক’রে নিতে পারিনা আগের মতো। এখন ছুটি-র আনন্দ ভাগ করার থেকে ভোগ করার আনন্দটাই বেশি বলে মনে হয়।
ভাবছেন, স্বার্থপর! শুধু নিজের কথা ভাবে! তারও যে কারণ আছে মহাশয়া এবং মহাশয়। শুনুন তবে। সেদিন ট্রেনে ক’রে স্কুলে যাচ্ছি (অবশ্য প্রতিদিন ট্রেনে করেই যাই); আমার এক সহযাত্রী আমাকে প্রশ্ন করল— মাস্টারমশাই, কী ব্যাপার! ক’দিন স্কুল আসেননি কেন? ভালোমানুষের মতো উত্তর দিলাম— সেশন ব্রেক ছিল। শুনে সে লোকটি বলল— অ-অ-অ, ছুটি-ই-ই। আমি হাসলাম। ব্যাপারটা যে তার হৃদয়ঙ্গম হয়নি, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই মালুম হল। ভুরু কুঁচকে সে আমাকে প্রশ্ন করল, তা গরমের ছুটি তো আমার ভাগ্নের স্কুলে শুরু হয়নি, আপনাদের বুঝি অনেক আগে হয়! আমি বললাম— গরমের ছুটি পড়েছে কোথায় বললাম! বললাম তো সেশন ব্রেক চলছিল। মানে একটা একাডেমিক সেশন থেকে আররেকটা একাডেমিক সেশনের মধ্যে যে গ্যাপ থাকে, তার ছুটি। ভদ্রলোক এবার বললেন— মানে গরমের ছুটি আর পড়বে না! আমি বললাম— হ্যাঁ পড়বে তো, ওটা আলাদা। সে চোখ আর মুখ যতদূর সম্ভব গোল ক’রে বলল, আবার ছুটি! আমি বললাম— আপনার অসুবিধে থাকলে স্কুলে এসে একটা কমপ্লেন করুন। সে তার বাড়াবাড়ি রকমের বাড়াবাড়ি বুঝতে পেরে ঢোঁক গিলে বলল— না, আমি ঠিক তা বলিনি—
আরেকটা ঘটনার কথা বলি— একদিন সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছি, হঠাৎ এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। চেঁচিয়ে ডাকল। সাইকেল দাঁড় করালাম। সে একমুখ হেসে জিজ্ঞেস করল— কেমন আছিস ভাই? আমিও ততোধিক আপ্লুত হয়ে বললাম, ভালো, ভাই। তুই? সে আর এই কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না; তার বদলে বলল— আজ তো স্কুল ছুটি? আমি বললাম— কীসের? সে এক গাল হাসি ঠেলে বলল— কেন, আজ তো নীল ষষ্ঠী। আমি বললাম— হ্যাঁ রে, বারো বছর তো স্কুলে পড়লি, কলেজ আরো তিন; বলি, নীল ষষ্ঠীর ছুটি কখনো পেয়েছিস? বাবা অসুস্থ, তাই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিলাম; এখন ওষুধ কিনতে বেরিয়েছি। এবার সে তার সামনে থেকে দৃশ্যমান সবকটি দন্ত বিকশিত ক’রে বলল— সরি ভাই। এবার যাই তাহলে? আমি বললাম— বিদায়।
হা ঈশ্বর, যদি পরের বার জন্মাই (চান্স নেই যদিও), তবে আমাকে আর যাই ক’রো, মাস্টার বানিয়ো না। স্কুলের ছুটিটা যে মাস্টারমশাইদের দিকে তাকিয়ে বানানো নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বানানো— তা এই অবোধদের বোঝাবে কে!
মাস্টারমশাইদের জীবনে এই অপবাদ শুধু বাইরে নয়, ঘরেও জোটে প্রায়শই। এই তো সেদিন, প্রচন্ড গরমের মধ্যে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সবে ব্যাগটা রেখে বউয়ের কাছে জল চেয়েছি, বউ এসি ঘর থেকে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে সামনে এসে দাঁড়াল। আমি জলটা খেয়ে তৃপ্ত মুখের একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকিয়েছি, বউ অমনি বলে উঠল— কী ব্যাপার, এতো হাসি মুখ? আমি বললাম— কিছুই না, তুমি এই গরমে এক গ্লাস ঠান্ডা জল খাওয়ালে। তাছাড়া—। বউ জিজ্ঞেস করল— তাছাড়া কী? আমি বললাম— কাল থেকে গরমের ছুটি পড়ছে জানো! বউ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল— ব্যাস, হয়ে গেল। কাল থেকে তোমার খিদমত খাটতে-খাটতে আমার হাড়মাস কালি হয়ে যাবে। আমি বললাম— চলো না, কোথাও ঘুরে আসি; এই কাছে পিঠেই। বউ বলল— তুমি যাবে না, আমি যাব। কয়েকদিন বাপের বাড়ি কাটিয়ে আসব। আমি তেত্রিশ কোটি দেবতার পায়ে সেলাম ঠুঁকে বলি— যাও তবে, কিছুদিন কাটিয়ে এসো। বউ হয়তো পরদিন সকালে বাপের বাড়ি গেল, আমি ওর সামনে মুখ বিষণ্ণ ক’রে দাঁড়িয়ে রইলাম। বউ বলল— ঠিক ক’রে খাওয়া-দাওয়া ক’রো কিন্তু। সারাক্ষণ লেখাপড়া আর ছবি এঁকো না। চোখ খারাপ হয়ে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে বেশিক্ষণ আড্ডা দেবে না। আমি বললাম— তুমি না-থাকলে আমার মনটা আগে খারাপ হবে। বউ চোখ ছল-ছল ক’রে বলল— লক্ষ্মীটি, রাগ ক’রো না। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। আমি আর বেশি কথা এগোলাম না। মন খারাপের এক্সপ্রেশনটা আর বেশিক্ষণ হয়তো ধরে রাখতে পারব না। তাই ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিলাম। আর ও বাড়ি থেকে বেরোতেই— ‘ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—...ইয়াক—ইয়াক’! আমার গরমের ছুটি শুরু—