রেখা রায়। বজবজ।
প্রাক্তন প্রধানা শিক্ষিকা
ডোঙ্গাড়িয়া অনুমতি বালিকা বিদ্যালয় (উ: মা:),
দ. ২৪ পরগণা
এখন অবসরে আমি। যখন স্কুলে ছিলাম তখনকার কথা বলি। তখন ডিজিটাল যুগ হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ের ওপর এতটা শ্বাস ফেলেনি। হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের প্রধান হলে যা হয়! স্কুলে একটু বেশি সময় দিতে হয়। গেটের চাবি খোলা থেকে ছুটির পর সকলকে বাড়ি পাঠিয়ে আবার গেটে তালা ঝোলানো পর্যন্ত স্কুল চত্বরে থাকতে হতো। বাড়ি থেকে ঘন্টাখানি দূরত্বে স্কুল। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম গুছিয়ে বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়ানো। যানবাহনের এত ঘনঘটা তো ছিল না। এক আধজনের নিজস্ব গাড়ি থাকত।
ঘরদোর অগোছালো সারাবছর। এমনিতে দেখলে এলোমেলো মনে হয় না। কিন্তু অতিথি এলেই চোখে পড়ে.. সিলিংয়ের কোণায় পাড়া-প্রতিবেশীসহ মাকড়সার গেরস্থালি। পাখার ব্লেডটায় ডাকপাখির বাচ্চার ডানার মত কালো কালো কী! আলনায় যাবতীয় ন্যাকড়াচোপড়া! ড্রেসিং আয়নায় কত টিপ সাঁটা আর ছোপ ছোপ দাগ! দেখো দিকি...পর্দার কোণা যে রিং থেকে খুলে কেতরে পড়েছে! ছুটি পড়লেই আত্মীয়দের আনাগোনা শুরু হবে। কী ভাববে ওরা!
ভেবে রাখি গরমের ছুটি শুরু হলেই প্রথম এক হপ্তা ঘরদোর সাফসুতরো করব। কিন্তু ভাবাই সার! বইমেলা থেকে সদ্য কেনা বই নেশা ধরায়। চৈত্রসেলে কেনা শাড়িগুলোতে ফলস বসেনি, ব্লাউজ করতে দেয়া হয়নিকো।উনুনে ভাত তরকারি পোড়ে, দুধ উথলায়। ঘরদোরে আরও ঝুল জমে। শাড়ি-ব্লাউজ যেমনকে তেমনি আলমারির অন্ধকার কোণায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আলোর মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।
গরমের ছুটির মধ্যেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোয় কেন কে জানে!বালিগঞ্জ স্টেশনের পাশের স্কুলে মার্কশিট ডিস্ট্রিবিউশনের কেন্দ্র। ভ্যাপসা গরমে সকাল থেকে লাইন দিই গ্লুকোজের জল বোতলে ভরে। সকাল সাতটায় গেলে যেমন লাইন, বেলা এগারোটায় গেলেও তাই। প্রতিবেশি স্কুলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলে...কোন স্কুল আগে মার্কশিট নিয়ে পৌঁছোতে পারে স্কুলে। অভিভাবকেরা বলাবলি করে...অমুক স্কুলে ছেলেরা মার্কশিট হাতে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। গার্লস স্কুলে এখনও বড়দি আসেনি?
তখন মার্কশিট ছাড়া অন্য উপায় ছিল না পাশ-ফেল জানার। শ্রান্ত ক্লান্ত আমি ঘামতে ঘামতে দুপুর রোদে বাস থেকে নেমে স্কুলে গিয়ে দেখব মেয়েরা অধীর আগ্রহে ভীড় করেছে। কিছু দিদিমণিও এসে গেছেন প্রিয় ছাত্রীদের রেজাল্ট জানতে। অফিসও উপস্থিত। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অফিসে ডকুমেন্ট রেখে রেজাল্ট তুলে দিতে হবে মেয়েদের হাতে। ফেল করা বা ব্যাক পাওয়া ওদের মুখ দেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠত।
গরমের ছুটির মধ্যেই ভোটের ডিউটি পড়ত। তখন বিরক্তির একশেষ। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া যেত না। কখন রাজার চিঠি (ট্রেনিংয়ের) আসে! বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে ভোট নিতে যাওয়া। স্কুলে স্কুলে বুথ। অনেক স্কুলে পাখা নেই, ওয়াশরুম নেই। ওয়াশরুম থাকলেও ব্যবহারের অযোগ্য। গরম আর মশার জ্বালায় আগের রাত কাটে নির্ঘুম। জীবন সেদিন হাতের মুঠোয়। নাওয়া-খাওয়া ভুলে তখন যমালয়ে জীবন্ত মানুষ ছাড়া নিজেকে আর কিচ্ছু ভাবা যায় না। প্রবল ইচ্ছে থাকলেও কোথাও দুদিন ঘুরতে যাবার জো নেই। বাপের বাড়িও না। বিরক্তিকর একঘেয়েমির জাবরকাটা!
সে সময় ফেসবুক না থাকায় দেখনদারি বিশেষ ছিল না। বাঙালি ছুটি কাটাতে কোথায় যাচ্ছে না-যাচ্ছে জানা যেত না। স্কুল খুললে এ্যালবামে সোনালি কর্ণার দিয়ে ছবি সাজিয়ে তলায় ক্যাপশন লিখে ইয়াব্বড় একটা এ্যালবাম বগলে স্টাফরুমে ঢুকতেন দিদিমণিরা। হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। ছুটির শেষের দিকটা বাড়িতে ওই নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন ওঁরা। তারই মাঝে ছেলেমেয়ের হোমওয়ার্কে সাহায্য করা, বাড়ি মেরামত আর রঙ করা, বাগান পরিচর্চা, সুযোগমত নন্দন চত্বরে একটু ঢুঁ মেরে নিজেকে আপ-টু-ডেট করা চলত। ব্যাগ গুছিয়ে হৈ হৈ করে বেরোবার মত আর্থিক সঙ্গতি বা মন সবার ছিল না।
সেবার ৪১° গরমে যখন সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, আমার কর্তা তদ্বির করে দার্জিলিং মেলের আড়াইখানা টিকিট জোগাড় করলেন কিছু বাড়তি গচ্চা দিয়ে। বাঙালি তখন "দীপুদা"-র বাইরে কিচ্ছু চেনে না। চলো দার্জিলিং। পোঁটলাপুঁটলি গুছোনোর কী হুড়োহুড়ি! শীতের জামাকাপড়ে ব্যাগ ভর্তি। ট্রলির বাহার চালু হয়নি। কুলির ওপর ভরসা। রাতের রেলগাড়ির দুলুনিতে শালপাতার থালায় লুচি মাংস আর সন্দেশে খাবারের স্বাদ-গন্ধ বদলে যায়। যে না খেয়েছে সে জানে না। এখন তো গাড়িতেই লোকে বিশ্রী খাবার কিনে খায়। তখন মানুষের হাতে অত কাঁচা টাকা ছিল না। আর থাকলেও কিপটেমির চূড়ান্ত। বেশিরভাগ লোকজন বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গাড়িতে উঠত। আমিও তাই করতাম। অবাঙালিরা চার ছ-থাক সবজির ডিব্বা খুললেই জিভে জল আনা আচারের গন্ধে ট্রেনের কামরা ম-ম করত।
দিনসাতেক মেঘকুয়াশা মেখে আবার সেই হাঁসফাঁস করা ঘেমো গরমে বাড়িতে ফিরে জামাকাপড়ে মাড় দেয়া, ইস্ত্রি করা,বাচ্চার ইউনিফর্ম রেডি করা ইত্যাদি প্রভৃতি কাজ। ইতিমধ্যে আকাশের কোণে সামান্য মেঘ দেখা গেলে ময়ূরের মত মনটা নেচে উঠত।একটু স্বস্তি। স্কুল খোলার দিন মাথায় মেঘ নিয়ে বাসে উঠি। নামার মুখে নামল হুড়মুড়িয়ে। কাচা শাড়িখানার দফারফা। তবু কিঞ্চিৎ আনন্দ এই ভেবে যে শুরুতে রেনি-ডে হতেও পারে! কিন্তু স্কুলের বড়দি যে! যথাসম্ভব মুখটা গম্ভীর করে স্কুলের গেটে পা রাখি।