সুস্মিতা বিশ্বাস, আগারপাড়া
খুব ছোটোবেলায় সরস্বতী পুজো মানেই ছিল; মামার বাড়ির-মাসির বাড়ি। যেখানে আমরা ভাই-বোনেদের পল্টন জড়ো হত পুজো উপলক্ষ্যে। পুজোর আগের দিন থেকে আমরা প্যান্ডেল সাজাতাম। রঙিন কাগজ কেটে, আঠা দিয়ে গোল গোল শিকল তৈরি করে খুঁটির চারপাশে ঝুলিয়ে দিতাম। ছিঁড়ব-ছিঁড়ব করেও , যেসব না ছেঁড়া শীতফুলের শোভা তখনও ফুটে থাকত; নিজের বাড়ি, পাশের বাড়ি থেকে সেইসব টব জোগাড় করে এনে প্যান্ডেলের গেট সাজাতাম। আর খড়িমাটি দিয়ে গোল করে লক্ষণরেখা কেটে দিতাম। যাতে ঠাকুর দেখতে এসে কেউ ফুলগুলো ছিঁড়ে না ফেলে। হলুদ বাল্বের আলোয় যখন প্যান্ডেল সেজে উঠত, সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন রাত হত, তখন পাশের বাড়ির রুনুদা আসত। চোখে চশমা, ঝুল-চাদর গায়ে, কোঁকড়া চুল। প্রেম আর পুজোর যে কোনও এক অলিখিত সম্পর্ক থাকে। বেশি কিছু না বুঝলেও, ওই পুঁচকে বয়সেও একটা হালকা খুশিতে মন ভরে উঠত। তারপর আমার কাজের ঘটা বেড়ে যেত হুট করে। তাতে আর যাই হোক, কাজের কাজ কিছু হত না। যাইহোক, সিডিতে যে গান বাজত মনে হত সেটা যেন শুধু আমার জন্যই বাজছে। আর ঠিক তখনই চিল্লাতে চিল্লাতে মা আসত। ঠান্ডা লেগে যাবে বলে একটা হনুমান টুপি কি বৌ টুপি পরিয়ে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে যেত।
ব্যাস আর কি! তখন পেপারে ঢাকা মা সরস্বতী নিশ্চয়ই খুব একচোট হাসত। বাড়ি ফিরে ঠোঁট ফুলিয়ে গরম গরম দুধ-রুটি খেয়ে, ভাগাভাগির কম্বলের তলায়, দিদার শোনানো রূপকথার গল্পের ওমে একসময় অভিমানেরা ঘুমিয়ে পড়ত।
পরদিন সকালে টিন বা টালির চালে কুয়াশা ঝরার টুপ-টাপ শব্দ শুনে ঘুম ভাঙত। দেখতাম ততক্ষণ বড়দি মেজদি জেগে গ্যাছে। শীলপাটায় হলুদ ঘষছে। স্নান করতে ইচ্ছা না করলেও, মাসির রাখা হলুদ শাড়ি পড়ার লোভে স্নান সেরে নিতাম হলুদ মেখে। তারপর শাড়ি সামলাতে সামলাতে মণ্ডপে পৌঁছে যেতাম ছোট্ট-ছোট্ট পায়ে। বামুন ঠাকুর তখন পুজো গুছিয়ে রেডি। আমাদের অঞ্জলি সেরে অন্য প্যান্ডেলে ছোটার জন্য ব্যস্ত। বেশ কোলাহল সহকারে সবাই যখন কার কতটা অঞ্জলি মুখস্থ আছে সেটার প্রমাণ দিতাম; তখন মনে মনে পুজোর আগে যে কুল খেয়ে ফেলেছিলাম সেই ভয় আর পাপবোধের ক্ষমা পেতে গলার সুর এককাঠি চড়ে যেত। শুধুমাত্র এইবার পাশ করিয়ে দাও মা ,তবে পরেরবার আর ভুলেও কুল খাব না। পাক্কা প্রমিস!
পুজো শেষে এক ছুটে বাড়ি চলে আসতাম। কারণ এমনিতেও খিদে পেয়েছে, তারপর বাড়িতে দিদার হাতের সরা পিঠে ডুবে আছে ঝোলা গুড়ে। পুজো শেষ পেটপুজো শুরু। দুপুরে আমরা সবাই যেতাম কোনও সিনেমা দেখতে। দাদা-দিদিদের নতুন বন্ধুরা আসত। দিদি বারবার বলে দিত বাড়িতে গিয়ে যেন না বলি ওই নতুন বন্ধুর কথা। বললেই পরের বার সিনেমা ক্যানসেল। যদিও পরের বার আর সেই বন্ধুকে কোনও দিন দেখিনি। দিদির মনে আছে কিনা জানিনা আমার মনে আছে এখনও, সেদিন কোন সিনেমাটা দেখেছিলাম। তারপর বড় হতে হতে পুজোর প্যান্ডেল, প্রয়োজন, প্রার্থনা সব পাল্টে গেল । স্কুল-কলেজে সদ্য যৌবনে, প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো লুকোচুরির পুজো। স্যার-ম্যাডামের টিউশন ব্যাচে খিচুড়ি খাওয়ার মজা। নিজের ছাত্রদের জন্য, নিজের দায়িত্বে করা পুজোর আয়োজন.... সবশেষে অনলাইন পুজো। বাঙালির সরস্বতী পুজো যেন এক ছোট গল্প। আবেগে-আনন্দে প্রতিবার, প্রতিজনের কাছে নতুন নতুন উপলদ্ধি নিয়ে আসে। শেষ হয়েও শেষ হয় না। অপেক্ষার পরের বছরের জন্য নতুন করে কিছু গল্প লেখার রসদ সাজিয়ে রাখে ।