পয়লা বৈশাখ আর আমাদের ছেলেবেলার টুকরো স্মৃতিগুলো

তন্ময় রজক, পুরুলিয়া 

 

এসো হে বৈশাখ এসো এসো। ঝির ঝিরে লু , এপ্রিল পেরিয়ে আসতে আসতে টোকা দিচ্ছে আমাদের গায়ে। জানান দিচ্ছে বিগত বছরের জরা সরিয়ে আজ প্রথম বৈশাখ। গেরস্থালির ঘর মাত্র রাতে এবং ভোজন রসিক বাঙালির দুপুরের পাতে বৈশাখ আসছে। আমসত্ত্ব থেকে আম ডাল, এঁচোড়ের কষা থেকে এঁচোড়ের ডালনা হয়ে কোপ্তা পর্যন্ত পাত পেড়ে খাওয়ার বৈশাখ আসছে। তবে কি শুধুই এইটুকুই? বাসকিন রবিন থেকে পাড়ার মোড়ের পূজা আইস মিল্ক, মাথার ঘাম মুছে জিভে জল। এই সবকিছু দেখতে দেখতে কখন যেন মনটা পৌঁছে যায় ছেলেবেলায়। ঘটনার সারি ভিড় করে আসে। কাঁদতে বসলে মনে পড়ে সাত পুরুষ আর লিখতে বসলে মনে পড়ে সাত জন্মের কথা। যখন ভরা বৈশাখে মাসীমণি চিঠি লিখতেন বাবাকে নববর্ষের প্রণাম শুভেচ্ছা জানিয়ে, ইস্কুলে তখন গ্রীষ্মের ছুটির তোড়জোড়। ভোরবেলা ব্যাট হাতে চার্চের মাঠ, বিকেলে খোলা মাঠে বট গাছের নিচে আড্ডা।

পয়লা বৈশাখে সে সময় রবীন্দ্র ভবনের বাইরে জটলা করে একটা অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানে আমাদের মত ছোট ছোট শিল্পীদেরও আমন্ত্রণ থাকতো তবলা ইত্যাদি বাজানোর। গরমের ছুটি পড়ে যাব পড়ে যাব এরকম অবস্থা ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে বলে বাড়িতে আর বিশেষ বাধা ইত্যাদি দিত না। সাত দিন আগে থেকে রিহার্সেল ভোরবেলা সাড়ে চারটের সময় উঠে ছুটতে ছুটে যাওয়া অদ্ভুত এক মজা ছিল। রিক্সা নিয়ে আসতেন মনোহর কাকা তবলা সহ আমাকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকত তার। সাদা পাঞ্জাবি সাদা পাজামা উড়িয়ে দিয়ে মা নিয়ে যেতেন। ফেরার সময় টিফিনের প্যাকেট হাতে কচুরি তরকারি খেয়ে বাড়ি ফেলা হতো। তারপর আবার সারা বছরের মঙ্গল কামনায় দেওয়া হতো শ্মশান কালীর মন্দিরে পুজো দিতে।

বয়স যেমন বাড়ে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে যুক্তিবোধ তর্ক করার ক্ষমতা আর আশপাশটাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়ার একটা তাগিদ। ঠিক এরকম ভাবে বড় হতে হতে মনে হয় সেই কটা অনুষ্ঠান যেখানে তবলা বাজিয়েছি শুধুমাত্র একটা টিফিনের প্যাকেটে তারা আমাকে দিয়ে নিছকই নিজের কাজটুকু পার করে নিয়েছেন। এর বৈশাখী প্রার্থনায় আমার জন্য একটা শব্দ দূরের কথা একটা অক্ষরও ছিল না। এই মন্তব্য ভীষণ রকম ভাবে নেতিবাচক শোনালেও বাস্তবিকতা কিন্তু তাই। নিজের আশপাশটাকে যতই যতই সদর্থক ভাবে দেখার চেষ্টা করুন, আশেপাশের সমস্ত উপাদান মিলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হবে যেখানে ক্রমশ নেতিবাচক দিকগুলি প্রকট হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন এক বিজ্ঞ গায়িকা একবার ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় মাইক ম্যানকে দোষ দিয়ে বসেছিলেন।

তবুও কি বৈশাখ আনন্দ আনে না? কালবৈশাখীর শেষে জলে ভেজা রোদ্দুরে কি মায়াবী এক  দৃশ্যায়নে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় না আমাদের? কালবৈশাখীর ঝড়ে আম কুড়ুতে যাওয়া ছেলেরা কি অনাবিল একটা আনন্দ নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফেরে না? চাল চুলো নিয়ে ঝগড়া করা দুটো লোক কি কোনদিন ঝড়ের শেষে ছাদে উঠে মায়াবী সূর্যাস্ত দেখেন না?  আমরা আসলে যে বৈশাখ কে উদযাপন করি সেই বৈশাখ লু এর সঙ্গে নিয়ে আসে ভালবাসার প্রবাহ, নতুনের আশ্বাস আর স্নেহের একটা স্রোত; ঠিক যেন কেউ অসমিনা দিয়ে সযত্নে ঢেকে রেখেছে আমাদের ছেলেবেলার ছোট ছোট টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...