ঝিলিক অধিকারী দত্ত চৌধুরী, বর্ধমান
ছোটবেলা থেকে কালীপুজো শব্দটার মধ্যে একটা ‘ফ্যাশিনেশন’ কাজ করত। কালীপুজো মানেই আমার কাছে বাবার গল্প।
দুর্গাপুজো কেটে যাওয়ার পর আবার সেই স্কুলে ছুটি পড়ার অপেক্ষা। চারদিকে আলোর রোশনাই। ঝমলমলে প্রদীপ। ক্যাপ বন্দুকের আওয়াজ। যে বাজিতে জোরে শব্দ হত সেই বাজিতে আমি একটু ভয় পেতাম। তাই বাবার কাছে বায়না করতাম, ‘ বেশি করে ক্যাপ কিনে দাও’।
বাবা খুব অন্যরকম মানুষ। তাঁর দেখার চোখ, ভাবনা-সবটাই ছিল খুব আলাদা। বরাবর বলতেন, মা কালী মেয়েদের সৃষ্টি করেছেন শক্তির প্রতিরূপ। তিনি তাঁর উপস্থিতি দিয়ে আমাদের জীবনের সব অন্ধকার দূর করে দেবেন। বলতেন, মেয়েরা কেউ হতে চায় সরস্বতী, কেউ বা দুর্গা কিন্তু মা কালী কেউ হতে চায় না, কিন্তু আমি চাই তুই মা কালীর মতো হ’।
ছোটবেলায় কথাটার মানে বুঝতাম না। ঠাকুমা বলত, কালী পুজোর দিন বাড়িতে প্রদীপ, মোমবাতি জ্বালাতে হয়, তাতে বাড়িতে অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে পারে না। বাবা গল্প বলতেন, কীভাবে মা কালী অসুর বিনাশ করেছিলেন।
একবার কালীপুজোর সময় আমাদের বাড়িতে কোনও আলো জ্বলেনি। কারণ সে বছরটা ঠাকুমা আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাই উৎসব বন্ধ। সব কিছু মিলিয়ে সবাই খুব মন খারাপে। আমারও মনটা ভালো ছিল না। দুটো কারণ ছিল তার। এক তো ঠাকুমা বিদায় নিয়েছেন, আর তাছাড়া আমার বয়সটা তখন খুবই কম, বাচ্চাদের যা হয় এই, চারদিকে রং-বাজি-আলো-উৎসব-রোশনাই, আর আমার বাড়িতে অশৌচ, তাই আলো জ্বালতে নেই, সব অন্ধকার।
বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আমার মনটা খুবই খারাপ। আমার কাছে এসে বললেন, ‘ চল মা, এক জায়গায় যাব’। সঙ্গে সঙ্গে আমি রাজি হয়ে গেলাম।
বাব আমায় বাইকে করে বাজারে নিয়ে গেল। তারপর অনেক প্রদীপ, মোমবাতি, বাজি, বন্দুক, ক্যাপ কিনে দিল। আমি তো প্রচন্ড অবাক! বাবাকে জিজ্ঞাসা করলা্ম, ‘ এই যে মা বলল আমাদের অশৌচ!
শুনে বাবা শুধু বললেন, ‘ এটা আমাদের নয় ম’।
তারপর আমাকে আরো একটা জায়গায় নিয়ে গেলেন বাবা।
আমাদের বাড়িতে যে মাসি মাকে কাজে সাহাজ্য করতেন তাদের বাড়ি। মাসির ছোট-ছোট দুই ছেলে। তাদের হাতে কিছু বাজি- মোমবাতি দিয়ে বাকি প্যাকেট মাসির হাতে তুলে দিলেন বাবা। মাসিকে বললেন, অবশিষ্ট যা বাজি আছে সব পাড়ার বাচ্চাদের দিয়ে আসতে।
বয়সে তখন অনেকটাই ছোট ছিলাম আমি। সেই প্রথম নিজের বাড়িতে আলো দিতে পারলাম না। বাজি পুড়ল না। বন্দুক কেনা হল না। কিন্তু ওই বাচ্চাগুলোর মুখে যে অনাবিল হাসিটা দেখেছিলাম তা আজও, এত বছর পরেও মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছে।
সে বছর আমিও অসুর দমন করেছিলাম। আমার মনের মধ্যে বাস করা স্বার্থপরতার অসুরটিকে।