লক্ষী মেয়ে দস্যি হোক না, চাইনা লক্ষ্মীমন্ত…

ছোটবেলা থেকে মাকে দেখতাম, বৃহস্পতিবার এলে দুপুরবেলা স্নান সেরে পুজোয় বসত। লক্ষ্মী পটের সামনে দুলে দুলে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ত।

কী আছে সেই পাঁচালিতে?

তাতে লেখা- “স্থির হয়ে রহ যদি প্রতি ঘরে ঘরে, তবে কি জীবনের এত দুঃখ হতে পারে।"

মানে, লক্ষী হতে হবে স্থির ধীর। এই সময়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীর সংজ্ঞা কি তাই-ই?  উত্তর সম্ভবত, ‘না’।

IMG-20231027-WA0024

হিন্দু ধর্মে, দেব-দেবী উভয়ের ধারণাই যেহেতু পুরুষেরাই তৈরি করেছে, তাই, তারা ঠিক যেভাবে নারীকে কল্পনা করেছে, বা দেখতে চেয়েছে, সেই আদর্শ রূপকে দেবী হিসাবে তুলে ধরেছে তার ধর্মে-সাহিত্যে-লোকাচারে। আর সাধারণ রক্ত মাংসের মেয়েরা যুগের পর যুগ ধরে নিজেদের সমস্ত জাগতিক ইচ্ছা, কামনা ত্যাগ করে ছুটেছে সেই 'Unrealistic Standards' কে বাস্তবিক রূপ দিতে। যখন সেটা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, হয়েছে, ‘অলক্ষ্মী’।

যুগ বদলেছে, চিরাচরিত অলক্ষীরাই হয়ে উঠেছে এই যুগের লক্ষী। যে  রাঁধে, সে চুল ও বাঁধের নামে ঘরে বাইরে দুদিকেই একটা মানুষকে পিষে দেওয়ার দিন শেষ হতে চলেছে। ক্লডিয়া জোনস মানবীবিদ্যার এক উল্লেখযোগ্য থিওরি দিয়েছিলেন, 'Triple Oppression Theory’. অর্থাৎ, modernism এর হাত ধরে, নারী স্বাধীনতা যেমন এলো, এলো বাড়তি চাপ, পড়তে হবে, চাকরি করতে হবে, সঙ্গে সুন্দরীও হতে হবে। আগে শুধু রূপচর্চাটুকু করলেই হয়ে যেত, sexism, racism, classism বোঝার বাড়তি চাপ ছিল না।

যুগের সঙ্গে বদলেছে feminism এর ধারণাও। প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়েভে নারীবাদের ধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে দেবত্বের ধারণাই। নারীকে প্রায় দেবীর স্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই, কিন্তু তাকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ দিতে হয়েছে, সে আদৌ কতটা লক্ষ্মী হওয়ার যোগ্য, বা তার আদৌ সরস্বতী হওয়ার গুণ আছে কিনা।

কিন্তু, বর্তমান নারীবাদে এই প্রমাণের দিন প্রায় শেষ। এখন সমান অধিকার আদায়ের লড়াই। সমস্ত রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার লড়াই। ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই। সে লড়াই হতে পারে বেতন বৈষম্য, লিঙ্গ- ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রাপ্যতা, অনমনীয় সামাজিক প্রত্যাশা, বা লিঙ্গ- ভিত্তিক সহিংসতা।

কে লক্ষী, কে আদৌ অলক্ষ্মী, সেটা ঠিক করার জন্য আজ ও সমাজ অপ্রস্তুত। আজ ও কোনও মেয়ে রাতে দেরি করে কাজ থেকে ফিরলে, তার চরিত্রের ময়নাতদন্ত হয়। কোনো মেয়ে, প্রমোশন পেলেও তাই।  প্রতিবছর, মাতৃশক্তির আরাধনাকে ঘিরে যে বিপুল ব্যবসা চলে, দিন ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সেই মায়েদের - মেয়েদের চরিত্রকে ধরা হয় স্ক্যানারের নিচে, বিচার করে কারা? যারা, এই কদিন এদেরকেই দেবী জ্ঞানে পুজো করছিল। শেষে বলতে পারি, আমাদের দেবীজ্ঞানে পুজোরও কোনো দরকার নেই, আবার কন্যাভ্রূণ হত্যার ও দরকার নেই। আমরা রক্ত মাংসের মানুষ, শুধু সেই সম্মানটুকু দিতে পারলেই অনেক।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...