একবার কালীপুজো আর হিরো কাপ পড়েছিল একসঙ্গে

প্রসেনজিৎ দত্ত, কাশীপুর

 

ঘুমপাড়ানি মাসি নয় বরং ঘুমপাড়ানি ‘মেসো’― যে ঘুমের নয়, চিরঘুমের লোরি শোনাত। রাতের আবছায়ায় সে প্রকট হত। যারা গৃহহীন, তাদের প্রাণপাখিটাকে উড়িয়ে দিতে সে ভারি পছন্দ করত। বাবার কাছে শুনেছি, আশির দশকের এক্কেবারে শেষে ‘স্টোনম্যান’ নামক এক আততায়ী খুনি আবির্ভূত হয়েছিল। গৃহহীন ফুটপাথবাসীদের মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করত সে। ছয় মাসে সে তেরোটি খুন করেছিল।

 

আমার বয়স যখন বছর ছয়, সেবারের কালীপুজোয় আমার মামাদের সাধের ক্লাব কালীমণ্ডপের আগায় স্টোনম্যানের একটি কাল্পনিক মূর্তি রেখেছিল। কাল্পনিক মূর্তি কারণ, যে ওইসমস্ত ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তার হদিশ পাওয়া যায়নি। পুলিশ কয়েকজন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল বটে, কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাদের ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

 

তা সেই দাগি মানুষটিকে লম্বা-চওড়া, সুগঠিতই দেখতে হবে ধরে নিয়ে স্টোনম্যানের মূর্তি তৈরি করে মণ্ডপের সামনে রাখা হয়েছিল। তার হাতে ছিল মস্ত একটি পাথর। পাথুরে মানুষটির ছিল রাগি দু’টি চোখ লাল। তিরিক্ষি মেজাজ। যেন এইমাত্র ওই পাথর ছুড়ে মারবে। মনে আছে যে, শত চেষ্টাতেও ওই কালীমণ্ডপে আমাকে ঢোকাতে পারেনি মা-বাবা-মামারা। ভয় পেয়ে গিয়েছিল ছয় বছরের ক্লাস ওয়ানে পড়া ছেলেটি।

 

আমার মামার বাড়ি বিরাটিতে। কালীপুজোয় সময় বেশিরভাগ বছর কাটত সেখানেই। বিরাটি থেকে মধ্যমগ্রাম, বারাসত খুব বেশি দূরে নয়। ওখানকার বিখ্যাত কালীপুজোর কথা কমবেশি প্রায় সকলেই জানেন। বাবা পাড়ার পুজোয় বইয়ের স্টল নিয়ে বসতে হবে বলে তার শ্বশুরবাড়ি যেত না; বা গেলেও বুড়ি ছুঁইয়ে চলে আসত। তবে, মা ছিল ঠাকুর দেখার ব্যাপারে প্রবল উৎসাহী একজন মানুষ।

 

মধ্যমগ্রাম বারাসতের কালী দেখতে কম ঝক্কি পোহাতে হবে বলে মামাবাড়ি থাকাকেই শ্রেয় মনে করত মা। তা বলে বিরাটিও কম যেত না। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের পুজো, মহাজাতি, শরৎ কলোনী, পাঠানপুর এসব বিখ্যাত পুজোও তার দর্শনের তালিকা থেকে বাদ যেত না। তাই মামাবাড়ির ওখানকার পুজো দেখতে যাওয়াটাও ছিল চূড়ান্ত আনন্দের। উৎসবের নেশায় চিড়িয়ামোড় থেকে নাগেরবাজার পর্যন্ত দাদুর সঙ্গে মা হেঁটে যেত। আমি থাকতাম দাদুর কোলে। মনে পড়ে, হনুমান মন্দিরের ওখানে একবার কালীপুজোয় মূল মণ্ডপের ঢোকার আগে সামনে খোলা খান পাঁচ-ছয়েক ছোট ছোট প্যান্ডেল হত। সেখানে থাকত মানুষের বহুরূপী স্ট্যাচু। কেউ সাজত নটরাজ, কেউ সাবিত্রী সত্যবান, কেউ-বা বেহুলা লখিন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

মনে আছে একবার কালীপুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটা পড়েছিল হিরো কাপের সময়। ওইসময় লিগ পর্যায়ের একটি ম্যাচে ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে যাওয়ায় উৎসবের আনন্দে ভাটা পড়েছিল। আতশবাজি পর্যন্ত ফাটেনি। বাবার কাছে বাজি পোড়াব বলে বায়না জুড়ে দেওয়ায় বলেছিল, দশদিন পর দীপাবলি পালন করব। দশদিন পর ছিল ফাইনাল।

 

ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল সেই ক্যারিবিয়ানরা। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে অনিল কুম্বলে একাই ভেল্কি নাচন দেখিয়ে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। নিয়েছিল ছ-ছ’টা উইকেট। ভারত হিরো কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেদিন বুঝেছিলাম উৎসব কাকে বলে। কাকে বলে আলো আর আঁধারির মুগ্ধতা। প্রথম দেখা সেই জয়ের স্মৃতি আজও এভাবেই টাটকা। আজ হিরো কাপের ২৮ বছর পর আলোর উৎসবের মাঝেই চলছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ভারত বিশ্বকাপ জিতলেও হয়তো বাজি পুড়বে না। কারণ বাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাইকোর্ট। ছোটবেলা এবং বড়বেলা এ-দু'টি সময় নদীর দুই তীরের মতো। তার মাঝখান দিয়ে সেতু গড়ার দরকার নেই, দুই তীর উভয়েই আর এক হতে চায় না।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...