ডালিয়া সাহা, হাওড়া
৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটা এলে গোটা পৃথিবী ভেসে যায় শুভেচ্ছার বানে। ভেসে যায় মেয়েরাও। একটা দিনের জন্য। কিছু মুহূর্তের জন্য। কিন্তু সত্যিই কি এটা আমাদের দিন? সত্যি কি আমাদের জন্য পালন হয়?
একজন আইনজীবী হিসেবে বলব, সব দেখে সংশয়ে পড়ে যাই। আমি পেশায় ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। সারাদিন আমার কাজ অপরাধ আর অপরাধীদের নিয়ে। টেবিলে ফাইল জমে। কেস জমা পড়ে। মহিলাদের ওপর ঘটে চলা অপরাধ আর তার দুনিয়া জোড়া রেকর্ড সেই সংশয় আরও বাড়িয়ে দেয়। মেয়ে হিসেবে। মেয়ের মা হিসেবে।
‘পুত্র সন্তান নেই, তাই বিবাহ বিচ্ছেদে প্ররোচনা দিচ্ছেন স্বামী’। সামনে থেকে দেখেছি। দেখেছি আজও গ্রাম মফস্বলে মেয়ে হলে ঘরে কান্নাকাটি পড়ে যায়। “আমার কেন মেয়ে হল”!
ছেলে চাই। কারণ বংশের প্রদীপ যে ছেলে। ছেলেই নাকি বংশ এগিয়ে নিয়ে যায়।
ছেলের বদলে মেয়ে হল। কেন এল না ছেলে, শুরু হয়ে যায় শারীরিক নিগ্রহ। মানসিক অত্যাচার, শারীরিক নিগ্রহ থেকে বাঁচতে বিবাহ বিচ্ছেদে রাজী হয়ে যায় স্ত্রী।
আচ্ছা, আমরা কি বুঝব না, ‘বংশ রক্ষার জন্য শুধু ছেলে নয়, মেয়েও জরুরি’?
‘বংশ রক্ষা’ কী?
আমার ভাষায় ‘সম্মান’। পিতৃ পুরুষের নাম উজ্জ্বল করা। নিজের কাজের মাধ্যমে সম্মান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা। সেটা কি শুধু ছেলেরাই পারে? মেয়েরা পারে না?
তাহলে একজন মেয়ে যখন ‘বাড়ির বউ’ হয়, ‘মা’ হয় বা ঠাকুমা দিদিমা’র ভূমিকা পালন করে তাঁরা, ঘাম-রক্ত-শ্রম দিয়ে সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলে, তার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই?
আমার নিজের দিকে যদি তাকাই তাহলে বলব আমি এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবতী।
আমি একসময় আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম।
কারণ এক দুর্ঘটনা। ছোটবেলায় যে সময়টায় স্বপ্ন দেখতে শেখে মানুষ, চারপাশটা রঙিন হয়ে ওঠে ঠিক সেই সময় ঘটেছিল।
আমি তখন স্কুলে পড়তাম। অ্যানুয়াল পরীক্ষা চলছে। পরের দিন অঙ্ক পরীক্ষা। দপ করে জ্বলে উঠেছিল আগুনটা। একেবারে গায়ের ওপর। প্রায় ৩৫ শতাংশ। দগদগে।
ঘটনাটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। শুধুমাত্র নিপাট দুর্ঘটনাই। কিন্তু আমার পারিপার্শ্বিকের চোখে সেই দুর্ঘটনা কেবল ‘দুর্ঘটনা’ হয়ে থাকেনি। ক্লাস এইটের এক কিশোরীর এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রেমের রহস্য খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা। এই চারপাশটাকে আমি আমার চোদ্দ বছর বয়সী বুদ্ধি দিয়ে ঠিক বুঝতে পারিনি।
বোঝাতে পারিনি ওই সময়ে দাঁড়িয়ে এক স্কুল পড়ুয়ার প্রেমে পড়ার সাহস সহজ ছিল না।
বহুদিন পর্যন্ত যখনই যেখানে গিয়েছি একটা দুটো কথার পর ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্ন, ‘আমার অ্যাক্সিডেন্টটা কী করে হল?’। প্রচ্ছন্ন থাকত, ‘আমি কি প্রেমে পড়ে এমন করেছি’!
আমি চুপ করে যেতাম। উত্তর দিতে রুচিতে বাধত।
আমি মরার মুখ থেকে বেঁচেছিলাম। তবু আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আসলে আমার সমাজ আমায় বারবার চেয়েছে কোণঠাসা করতে। চেয়েছে আমি যেন ঘরেই থাকি। আমাকে দেখলে মানুষ ভয় পাবে...
তখন বাবা মা বললেন, ‘না, তুমি আগেও যেমনভাবে চলেছ, এখনও সেভাবেই চলবে। কখনই নিজেকে লুকিয়ে রাখবে না...’
অনেক বাধা এসেছে। অনেক বিপত্তি পেরিয়ে পড়াশোনা করেছি। এক তো দুর্ঘটনার যন্ত্রণা। পর পর সার্জারির যন্ত্রণা। তার ওপর লোকের কথা। শরীর পোড়ার যন্ত্রণা থেকে কথার যন্ত্রণা কিছু কম ছিল না।
এক এক সময় ঘরে বাইরে কথা উড়ে এসেছে। ওর বিয়ে দিয়ে দাও। আমি খুঁত মেয়ে। খুঁত ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও।
আমার বাবা-মা বলতেন ‘আমার মেয়ে নিখুঁত’।
এভাবেই যুদ্ধ করতে করতে পড়াশোনা শেষ করলাম। ল’ পড়তে ভর্তি হলাম। ক্রিমিনাম অ্যাডভোকেট হিসেবে কেরিয়ার শুরু করলাম সেও এক পর্ব।
আমাদের ফিল্ডে একটা কথা আছে। ‘ক্রিমিনাল অ্যাডভোকেট আর ডাক্তার এরা নিজের জন্য বাঁচে না’। মানে আমাদের জীবনটা পরার্থে। নিজেদের বলতে যে সময়টা সেটা আমাদের জীবনে নেই। আমাদের যখনই ডাক আসে তখনই বেরিয়ে যেতে হয়।
এমন অনেকদিন হয়েছে ফ্যামিলির সঙ্গে প্ল্যান করেছি, হঠাৎ ডাক এসেছে ফিল্ডে চলে যেতে হয়েছে। এভাবেই চলেছি। যতবার কঠিন সময় এসেছে ততবার নিজেকে বলেছি, ‘অনেকটা তো দেখলাম, আর একটু দেখি না...’
সেভাবেই উতরে গিয়েছি। সমাজকে শুধু একটাই বলার, ‘মেয়ে বলে অবহেলা করো না। দুর্বল, নড়বড়ে ভেব না’...
এখন আমিও মেয়ের মা। আমার বাবা-মা ঠিক যেভাবে আমাকে বড় করেছিল। মেয়েকেও সেই পথেই মানুষ করে তোলার চেষ্টা করছি প্রতিদিন। শক্তপোক্ত মন আর সোজা শিরদাঁড়ার মানবিক মানুষ।
অনেক মানুষকে দেখেছি বিভিন্নরকম দুর্ঘটনায় পড়েছে। দুর্ঘটনার ক্ষত সেরেছে কিন্তু তারা আর মূল স্রোতে ফিরতে পারেনি। হারিয়ে গিয়েছে। তাদের আর খাড়া করবার চেষ্টা কেউ করেনি। কিন্তু আমার সঙ্গে সেই ঘটনা ঘটেনি। পাশে পেয়েছি বাড়ির লোককে।
আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজের পায়ে। নিজের জোরে। ভেঙে পড়াটা জীবনের মানে নয়, উঠে দাঁড়ানোটাই জীবন... মেয়েকে এটাই শেখাই...