হেস্টিংস হাউস- কলকাতার অন্যতম ভূতের বাড়ি

কলকাতায় ছড়িয়ে আছে অনেক পুরনো বাড়ি, যার মধ্যে অনেকগুলো ভৌতিক হিসেবে বিখ্যাত। এই ভূতুড়ে বাড়িগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা একটা বাড়ি হলো আলিপুর জাজেস কোর্ট রোডের ইউরোপিয়ান স্থাপত্যশৈলীর একটা বিরাট দোতলা বাড়ি। বাড়িটি এখন আর মূল রাস্তার ওপর থেকে সরাসরি দেখা যায় না, কিছুটা গলিপথ দিয়ে ঢুকতে হয়। এই বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস এর শাসনকালে, ১৭০০ শতকের শেষের দিকে। সেই কারণে এই বাড়ির নাম হয় 'হেস্টিংস হাউস'।

বাড়িটি কেন ভৌতিক হিসেবে বিখ্যাত, সেটা জানতে হলে একটু বাড়িটির ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। নিজের শাসনকালে হেস্টিংস এই বাড়িটি ব্যবহার করতেন বাসস্থান হিসেবে। তিনি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাবার আগে, এটি নিজের একজন উত্তরাধিকারীর নামে দিয়ে যান এবং তারা বেশ কিছুটা সময় এই বাড়িতে পরিবারসহ বসবাস করেন (এই বিষয়ে বিস্তারিত বলছি এই লেখাতেই)। তারপর ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে যখন লর্ড কার্জন ভারতের গভর্নর জেনারেল হন, তখন তিনি এই বাড়িটি সরকারি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহার করার অনুমোদন দেন। তাই অনেক  ব্রিটিশ রাজকর্মচারী পরিবারসহ এখানে থেকেছেন।

এরপরে দেশ স্বাধীন হবার পরে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাড়িতে শুরু হয় Post Graduate Basic Tanning College, এবং ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে এখানে David Hare Tanning College এর মহিলা বিভাগটি শুরু করা হয়, যারা মহিলা স্কুল টিচারদের প্রশিক্ষণ দিতো। তিন বছরের মধ্যে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায়, যে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে একে আলাদা করে একটি মহিলাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়, যায় নাম দেওয়া হয় 'The Institute of Education for Women', এবং এখনো বাড়িটি সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে। 

এবার আসা যাক বাড়িটির ভৌতিক প্রসিদ্ধির বিষয়ে। গুজব আছে, এখানে এখনো আসেন ওয়ারেন হেস্টিংস এর প্রেতাত্মা (অনেক রক্ষী বিষয়টি স্বীকারও করেছেন বিভিন্ন সময়ে নাম গোপন করে)! বিষয়টি গোড়া থেকে বুঝতে, এবার চলুন এই ঘটনাটির একদম অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাক। 

History Of Kolkata images

ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কায়েম করার বিষয়ে লর্ড ক্লাইভের পরে যার নাম নেওয়া যায়, তিনি হলেন লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস। এর মধ্যে প্রথমেই যে বহুচর্চিত বিষয়টির মধ্যে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, সেটা হলো মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, ১৭৬৩ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন বর্ধমান, নদীয়া ও হুগলী জেলার কালেক্টর। এরকম গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার ফলে, তার হাতে ছিল অনেক ক্ষমতা। সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, অসৎপথে টাকা আদায় করা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন জমিদারদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করতেন তিনি। সাথে মীরজাফরের বিধবা স্ত্রী মুন্নি বেগমের কাছ থেকে ৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ১০৫ টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন তিনি, যেটা পরে প্রকাশিত হয়ে যায়। বিষয় প্রকাশ পাওয়ায় এবং ঘুষখোর, স্বৈরাচারী, নিষ্ঠুর ও অসাধু হেস্টিংসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসায়, বিরক্ত হয়ে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, তাকে পদচ্যুত করে ইংল্যান্ডে ফেরৎ পাঠায়। তার স্থলাভিসিক্ত হন নন্দকুমার। নন্দকুমারের সততায় মুগ্ধ হয়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম তাকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় হেস্টিংস ও নন্দকুমারের বিরোধ।

১৭৭৩ সালে হেস্টিংস দ্বিতীয় বার ভারতে এলেন গভর্ণর জেনারেল হয়ে। ততদিনে নন্দকুমারের জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। হেস্টিংস ভাবলেন, এই লোকটাকে হাতে রাখতে হবে। তাই জনসমাজে প্রভাবশালী নন্দকুমারকে বশে রাখতে তাকে ৩ লক্ষ টাকা উৎকোচ (ঘুষ) দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করে, একটি চিঠি লেখেন। কিন্তু এই ঘটনায় বিরক্ত হয়ে, সত্যনিষ্ঠ নন্দকুমার সুপ্রীম কোর্টে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সুপ্রীম কাউন্সিল অব বেঙ্গল এর সদস্য, জাস্টিস স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এই মামলার বিচার করেন। নন্দ কুমার ওয়ারেন হেস্টিংসের হাতে লেখা চিঠি কোর্ট এক্সিবিট হিসাবে দাখিল করেছিলেন। কিন্তু কোর্টে নিজের প্রভাব খাটিয়ে, হেস্টিংস বেকসুর খালাস হয়ে যান।

এরপরে হেস্টিংস উঠেপড়ে লাগেন, নন্দকুমার নামের কাঁটাকে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। সেজন্য ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু হয়, এবং সিদ্ধান্ত নেন সেটা করতে হবে আইনের পথ ধরেই। এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার হন হেস্টিংসের বন্ধু, সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি স্যার ইলাইজা ইম্পে। প্ল্যানমাফিক, নন্দকুমারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও তছরূপের অভিযোগ আনলেন হেস্টিংস। বললেন‚ জনৈক বোলাকি দাস শেঠের নাম ভাঙিয়ে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছেন নন্দকুমার, যেখানে বোলাকি দাস শেঠ বহুদিন আগেই মৃত। এলাইজা ইম্পের উদ্যোগে এই অভিযোগ সত্যি বলে প্রমাণিত হল। 'দোষী' সাব্যস্ত হলেন মহারাজা নন্দকুমার। তখন ব্রিটিশ আইন অনুসারে দুর্নীতি‚ তহবিল তছরূপের শাস্তি ছিল প্রাণদণ্ড। তাই ১৭৭৫ সালের ৫ অগাস্ট, নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয় জনসমক্ষে।

এই ঘটনার পরে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে হেস্টিংস ব্রিটেনে ফিরে যান। কিন্তু হেস্টিংস ফেরার সময়, ভুল করে এই বাড়িতে ফেলে যান একটা কালো রঙের কাঠের বাক্স, যেখানে ছিল নন্দকুমারের মামলার সম্পর্কিত অনেক নথি। সেই মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দেবার ঘটনাটা কিন্তু বেশিদিন চাপা থাকে নি। বেশ কিছুদিন পরে প্রকৃত সত্য উদঘাটন হয়, এবং বৃটিশ পার্লামেন্টে দুই বন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সেই কালো বাক্সটির মধ্যে যে নথিগুলো ছিল, সেগুলোর মাধ্যমে হেস্টিংস নিজেকে নিরপরাধী প্রমাণ করতে পারতেন। তাই তিনি ভারতে নিজের ভূতপূর্ব সেক্রেটারিকে চিঠি লেখেন, সেই কালো বাক্সটি উদ্ধারের জন্য। কিন্তু ততদিনে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে... কারণ বাড়ির সমস্ত আসবাব নিলাম করে দেওয়া হয়েছে! তৎকালীন Calcutta Gezette এ একটি বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়, যে সেই কালো বাক্সটি যে খুঁজে দিতে পারবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে! কিন্তু জিনিসটার আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। অবশেষে, বৃটিশ পার্লামেন্ট থেকে হেস্টিংস ও ইম্পেকে 'কমিটিং জুডিশিয়াল মার্ডার' এর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং দুজনকেই পদচ্যুত করা হয়।

আজও প্রায় দুই শতক পরেও, গভীর রাতে এখানে শোনা যায় ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ! সেখান থেকে নেমে আসেন অশরীরী একজন ইংরেজ রাজপুরুষ, ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে যান বাড়ির ভিতরে। সমস্ত আসবাব - দেরাজে তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজতে থাকেন... এবং সেটা না পেয়ে অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরে যান! বলা হয়, সেই অতৃপ্ত আত্মা হলেন লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস (The First Governor of Presidency of Fort William), যিনি এখনো আসেন সেই কালো বাক্সের খোঁজে। ভূতপূর্ব রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্ণর স্যার জেমস টেলর (James Taylor) নিজের কার্যকালে (১৯৩৬ - ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) পরিবারসহ এই বাড়িতে থেকেছেন। তিনি বহুবার এই হেস্টিংস এর প্রেতাত্মার উপস্থিতি অনুভব করেছেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ওনার স্ত্রী Lady Braid Taylor লাইফ ম্যাগাজিনে একটা ইন্টারভিউতে তার এই ভৌতিক অভিজ্ঞতাগুলো প্রকাশ করেছেন। 

এটা তো গেল হেস্টিংস এর ভুতের গল্প। এটা ছাড়াও এখানে আরও একটি ভৌতিক ঘটনার বিষয়ে শোনা যায়, যা পরোক্ষভাবে ওনার সাথেই জড়িত। ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে জলপথে বাংলায় আসার সময় জাহাজে ব্যারনেস ম্যারিয়ন ইমহফ নামের এক মহিলার প্রেমে পড়েন হেস্টিংস। হেস্টিংসের স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছিলেন। দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। সেই সময় ম্যারিয়নের বয়স ছিল ২২ বছর, ছিলেন তিন সন্তানের জননী। সুন্দরী ম্যারিয়ন আসলে জার্মানির নাগরিক ছিলেন। জার্মান সেনায় কর্মরত ছিলেন স্বামী কার্ল ইমহফ। পরবর্তী কালে ম্যারিয়ন এবং তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। সেই নিয়ে কলকাতার তৎকালীন সমাজে কম বিতর্ক হয়নি। পরবর্তীকালে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন ম্যারিয়ন এবং হেস্টিংস। 

১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবার আগে, এই হেস্টিংস হাউসের মালিকানা তিনি লিখে দিয়ে যান ম্যারিয়নের প্রথম বিবাহসূত্রে জন্মানো তিন সন্তানের একজন জুলিয়াসের নামে। এই জুলিয়াস এবং তার পরিবার এরপরে কয়েক প্রজন্ম এই বাড়িতেই বসবাস করেন, এবং এনাদের সকলকেই এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে সমাধিস্থ করা হয় (আমি বর্তমানে সেই সমাধিগুলির কোনো অস্তিত্ব পাই নি)।  শোনা যায়, এই পরিবারের অনেকেরই অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল। এখনো হেস্টিংস হাউসে একজন ব্রিটিশ মহিলার ছায়া দেখা যায় গভীর রাতে, যিনি এই বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ান। গুজব আছে, যে এটি ম্যারিয়নের আত্মা (যদিও উনি ইংল্যান্ডে মারা যান এবং সমাধিস্থ হন)। হতে পারে, এটা এই বাড়িতে সমাধিস্থ জুলিয়াসের পরিবারের কোনো মহিলার আত্মা! আর যদি এটি ম্যারিয়ন হোন, তবে তিনি হয়তো তার উত্তরপুরুষদের সমাধি দেখতে আসেন। 

এখানে আরেকটি ভৌতিক ঘটনার কথা শোনা যায়, যার সাথে অবশ্য হেস্টিংস এর কোনো সম্পর্ক নেই। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের নাগাদ এই বাড়িতে থাকতেন মিস্টার জর্জ উইলিয়ামস, যার ছিল ঘোড়দৌড় এর নেশা। তার এই নেশা ক্রমে আসক্তিতে পরিণত হয়েছিল।  তিনি এই বাড়িতে রেখেছিলেন পাঁচটি দামী বিদেশি ঘোড়া, যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল ধবধবে সাদা একটি ঘোড়া, নাম 'প্রাইড'। এই ঘোড়াটি উইলিয়ামসকে অনেক রেসে জিতিয়ে, প্রচুর টাকা উপার্জনে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রাইড এর দক্ষতা কমে আসে, এবং সে রেসে হারতে শুরু করে। তখনকার দিনে একটা কুপ্রথা ছিল, রেসের ঘোড়া কর্মক্ষমতা হারালে, তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো। সেরকম একটা শনিবার, রেসে হারার পরে উইলিয়ামস তার প্রিয় ঘোড়া প্রাইডকে এই বাড়ির আস্তাবলে গুলি করে মেরে ফেলেন। তারপর থেকে বহু মানুষ শনিবার রাতে একটা সাদা ঘোড়াকে বাড়ির বাগানের মধ্যে দিয়ে দৌঁড়াতে দেখেছেন। 

এবার মনে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সেই ভৌতিক ঘটনাগুলো কেন ঘটে? যারা অবিশ্বাসী, তারা হয়তো ফুৎকারে উড়িয়ে দেবেন বিষয়টা। কিন্তু যারা ভুতে বিশ্বাস করেন, তারা বলেন যে এই বাড়ির সাথে যে টানে এনারা জড়িয়ে গেছেন, সেই টানেই তারা এখনো ফিরে ফিরে আসেন। 

সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে বাড়িটা গমগম করে, কিন্তু সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই ঝুপ করে বাড়িতে নেমে আসে নৈঃশব্দ্য। ইতিহাসের কুয়াশায় বাড়ির হাওয়া হয়ে ওঠে ঘন। ইতিহাসের পাতায় থেকে যাওয়া কিছু ঘটনা জীবন্ত হয়ে উঠে আসে গভীর রাতে, যার সাক্ষী থেকে যায় বাড়ির নিশ্চল থামগুলো। যতদিন থাকবে এই বাড়ি, চলতে থাকবে এই ঘটনা... আর সাথে সাথে কোলকাতার বিখ্যাত ভৌতিক বাড়িগুলোর মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এই 'হেস্টিংস হাউজ'।

 

তথ্যসূত্রঃ

The Book Of The Indian Ghosts -  Riksundar Banerjee : Aleph Book Company

 

---

সলিল হোড় 

ঐতিহ্য গবেষক

কুঁদঘাট (দক্ষিণ কলকাতা)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...