‘বাবাদের ক্লান্ত হতে নেই’

তন্ময় রজক, পুরুলিয়া  

 

মফস্বলে শীতের সকাল। কুয়াশার কণায় মিশে যাচ্ছে সদ্য উনুন জ্বালানো দোকানির কাঠ কয়লার ধোঁয়া। সকালের সাদা আলোয় তা আরও উজ্জ্বল। সাইকেল চালাচ্ছেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক, মাথায় মাঙ্কি টুপি। সামনের রডে একজন, আর আরেকজন পেছনের ক্যারিয়ারে; ইস্কুল যাত্রী। এভাবেই ছোট ছোট কুঁড়িদের স্বপ্নের ফুল হওয়ার দিকে হাত ধরে এগিয়ে দেওয়া। সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থান এর বাইরে এ এক অদ্ভুত কর্তব্যের গল্প। প্রতিদিনের যাপনে যার অবাধ উপস্থিতি, শৈশব থেকে কৈশোর এবং তার পরেও আমাদের যে ছায়া ঘিরে রাখে প্রয়োজন এবং অপ্রয়োজন এর দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে, তার কাছেই ফিরে যাওয়া আনন্দে অথবা অভিমানে।

এই তো জগত চিনেছি, এই তো সাইকেল চালানো শিখেছি, এই তো পা রাখছি কলেজের গেটে। এসবের মাঝে কখন ভদ্রলোকের চুলে পাক ধরে গেছে দেখিনি। ভদ্রলোকের দেরি হয় না ঘুম ভাঙতে। ছোটবেলা থেকে দেখছি, সেই ভোর সাড়ে পাঁচটা। মর্নিং ওয়াকের সঙ্গেই সেরে ফেলা দিনের বাজার। মিলেমিশে রান্নার পর অফিসে আবার কেউ ইস্কুল বা কেউ অন্য কোন কর্মস্থলে ছুট। ফিরতে বিকেল-সন্ধ্যে-রাত্তির। তবুও ফেরার পথে অল্প কিছু নিয়ে আসা। রেল লাইনের ধারে ছোট্ট সেলুন। চেয়ারের দুই হাতলের ওপর রাখা পাটার ফালি। তাতে উঠে আধঘণ্টা স্থিত হওয়া। এর চেয়ে যন্ত্রণার কোন উদাহরন আর মনে পড়ে না সে বয়সে। তাতেও কখনও চকলেট আবার কখনও চোখ রাঙানি এই দুইয়ের বিকল্প প্রয়োগে ছোট হয়েছে চুল, বড় হতে শিখেছি আমরা। হোঁচট খেয়ে ছড়ে যাওয়া পায়ে মলমের আগে জুটেছে ধমক। হাত ভাঙলে জুটেছে নার্সিং হোমের কেবিনে বিনিদ্র এক লোক।

মেলা বসে ২২ তারিখ। মাইনে হয় পাঁচে। নিয়ে যেতে বললে বকুনি, তার পর যাওয়া। আমাদের সাধে নিজের সাধ্য মিলিয়ে ট্রাপিজের খেলা। পছন্দের খেলনা থেকে চিনি কাঠি, খামতি থাকেনি কিছুতেই। এর জন্য কোথায় আপোষ, কতটুকু আপোষ, টের পাইনি, কেউই টের পায় না। কেটে যাওয়া ঘুড়ির জন্য বায়না থাকে। এ বায়না সুতোর নিঃসঙ্গতার আগে ছুঁয়ে জেট ভদ্রলোকের মন। পরের দিন আসত গোটা তিনেক ঘুড়ি। এ রঙিন শৈশবের একূল-ওকূল জুড়ে এমনভাবে জড়িয়ে থাকা এই যেন এক চরিত। শূন্যে আউট হয়ে ফিরলে কখনও সে গল্প শোনেননি। পা ধুতে বলেছেন। বলেছেন পড়তে বসতে। নামতা থেকে জটিল পাটি গণিত, ঝালিয়ে দিয়েছেন নিজের তাগিদে। যেখানে বেতের প্রয়োজন ছিল সেখানে হয়ত নিজেই বুঝিয়েছেন নিজেকে।

তারপর বয়ঃসন্ধি। নিজেকে বড় মনে হয়, অথচ বড়রা পাত্তা দেয় না। তখনও স্বল্প গুরুত্বের বিষয়ে মতামত নিতেন ভদ্রলোক। ছোট থেকে বড় হবার পথ হয়ত পিছল করে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই জগৎ ভালো আর মন্দের এক অদ্ভুত লুডোর ছক্কা এটা বোঝাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। কখনও রান্না করেননি বিরিয়ানী। নিয়ে যাননি নৈনিতাল। এটা এক পক্ষ হলে অপর পক্ষে হয়ত ভীষণ ইচ্ছে থাকা সত্বেও করে উঠতে পারেননি। কে বলতে পারে! তারপরেও ষাটোর্ধ লোকটার চোখে মুখে ক্লান্তি দেখি না। দেখি না অবসাদের কালো ছায়া। অথচ এই ছায়া ঘিরে বেঁচে গেছি এত কাল। এই ছায়া ঘিরে ছুটতে শিখেছি। এই ছায়ায় দেখেছি বিশ্বাস, দেখেছি শোক। এই ছায়া ঘন, এই ছায়া নিবিড়। ঘোলাটে ওই চোখের দিকে তাকালে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়, তুচ্ছ মনে হয়। এ ঋণের শেষ নেই। এ ঋণের শোধ নেই, সুদ নেই। নেই কঠিন শব্দের জোড়াতালি দিয়ে সাজানো ঋণস্বীকার পত্র। কেবল বোধটুকু রয়ে যায়। বাবারা ক্লান্ত হন না; বাবাদের ক্লান্ত হতে নেই... 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...