নীপবীথি ভৌমিক, শান্তিনিকেতন
তখন আর কত বয়স হবে আমার। খুব বেশি হলে টু কি থ্রী। আবছা আবছা মনে পড়ে ঘটনাগুলো। দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল এসে ঠেকেছে টাকি শহরের রজিপুর গ্রামের কুহু কেকা বাড়ির চৌকাঠে। আমি খুব মনে হয় বারান্দায় কিছু একটা অকাজ নিয়ে মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ দেখি গ্রামের লোকজন সবাই দল বেঁধে আমাদের বাড়িতে আসছেন। হাতে আবীর। কিন্তু সময়টা দোলের দিন না। ভরা গরম কাল। মনে হয় এপ্রিল কি মে হবে। আর তাদের মাঝখানে আমার বাবা, ঠাকুরদা আর আমার বড়দা। পিছনে পুলিশ!
কিছুই তো বুঝতে পারছি না তখন এনারা কেন এমন করছেন। কেন তাদের হাতে এতো এতো ফুলের তোড়া, আবীর, মিষ্টি। কেনই বা মা ঠাকমা সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে! সত্যিই বলতে কি মাথায় তো এসবের কিছুই ঢুকছে না। তবে এটা স্পষ্ট মনে আছে আমার পুলিশ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। কারণ আমি তো জানি পুলিশ তো দুষ্টু লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেয় ! ভীষণ কেঁদেছিলাম সেদিন ভয় পেয়ে। আসলে ওইটুকু বয়সে ভোট কাকে বলে সেটা তো আর জানতাম না!
গোটা রজিপুর গ্রামটাই মনে আছে সেদিন উৎসবে মেতে উঠেছিল। যত দিন গড়িয়েছে, বড় হয়েছি আমি, ততই জেনেছি রাজনৈতিক জীবনে বাবার কোনো শত্রু ছিল না। সেদিনও তাই বিরোধী পক্ষও খুশি হয়ে ছিলেন আমার বাবার জয়ী হওয়ায়। আমার বাবা তার কলেজ জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। আর সেটা মত জেনেছি, যত বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে শেখেছি ততই উপলদ্ধি করেছি শুধু আমি বা আমার বোন নয়, আমার বাবা মনে হয় সারা গ্রামের মানুষেরই বাবা ছিলেন। কি না করেছেন ওই সময়টুকুতে। রজিপুরের দালাল বাড়ির নাম আজও হয়ত ওখানকার মানুষ মনে রেখেছেন।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি। বাবাও আমার অসাধারণ কেউ না। খুবই সাধারণ মানুষ। মানুষের মতো মানুষ। প্রকৃত মানুষের সংজ্ঞা যেটা হয়, সেটাই আমার বাবা। আর সাধারণ বলেই হয়তো আমার বাবার রাজনীতিটা আর শেখা হলো না। যদিও এসব কথা আমরা কখনো বলি, বাবা উত্তর দেন ' তোরা যেটা দেখছিস সেটা কখনোই রাজনীতি হতে পারে না'। আর তাই বোধহয় কোনো সুপারম্যান, বিজনেসম্যান কিছুই হতে পারেননি আমার বাবা। মানুষের কাছে ঘরের ছেলে হয়েই থেকে গেলেন আজও।
বাবাকে অজস্রবার দেখেছি নিজের গ্যাটের টাকা পয়সা খরচ করে অন্যদের সাহায্য করতে। আর এই দাতা কর্ণ হতে গিয়ে তিনি যে কতকিছু দান ছত্র করেছেন তার হিসেব নিকেশ নেই। আর এসবের হিসেব রাখেনি বলেই হয়তো আমার বাবার বিশাল কোন বাংলো বাড়ি নেই, গাড়িও নেই কোনো। বসিরহাট মহাকুমা আদালতের একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী আজ তাই শত হাত দূরে ' রাজনীতি' থেকে। সত্যিই বলতে কি, রাজনীতির কথা বললে বাবা এখন বিরক্ত হন। অথচ এটার জন্যই এককালে বাড়িতে দেখেছি ঠাকমার সাথে মায়ের সাথে বাবার ঝামেলা হতে। তবে আমার বাবার কাছে যা আছে তা হয়তো অনেক রাজনীতিবিদদের কাছেই নেই। বিভিন্ন রকমের বই আছে বাবার কাছে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন বাবা। বাবার কাছ থেকেই জেনেছি সাহিত্য এমনই একটা বিষয় যার বিস্তৃতি দেশ কাল, সীমার গণ্ডি পেরিয়ে। সারাজীবন নিজের কাজ, মানুষের পাশে দাঁড়ানো আর সাহিত্যের ভিতর ডুবে থাকা মানুষটাই আমার বাবা।