'অন্তরে মোর রঙের শিখা'
ফাগুনের বাতাসে গুঁড়ো গুঁড়ো আবির কণা। বালিকা মন ছুট, ছুট ,ছুট লাগায় ধুলো মাখা দিনে। ধূসর ধুলো ভিজে থাকত লাল, বেগুনি রঙ জলে। কোঁচকানো, বিবর্ণ ফ্রক ঝলমলে হয়ে উঠত যে দিন, ঠিক সেই দিন কলের জলের নীচে মাথা। ঝামর চুল বেয়ে রঙের নদী। মা বেশি ক'রে ঘিয়ের ময়ান দেওয়া গোল গোল ময়দার রুটিকে নিপুণ হাতে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নিমকি গড়ত। বাবা ডুবো তেলে ভেজে তুলে সে নিমকি চিনির রসে মাখিয়ে নিত। এলোঝোলো। আমরা ধুলো মাখা, রঙ মাখা হাতে সে অমৃত মুখে দিয়ে পৃথিবীকে উঠোনে নিয়ে আসতাম।
মথুরা বৃন্দাবনে নীল ঘনঘোর কানাই দুধ জ্যোৎস্না রাধাকে আবীরে ঘনঘোর ক'রে দিয়ে এক হয়ে যেত তনুতে, মনেতে।
গৌর নিমাই সাম্যের গান গাইবার জন্য ভুবন আলো ক'রে জন্ম নিয়েছিল,শচী মায়ের কোল জুড়ে,এই শুভ দিনে। দোল পূর্ণিমা তাই বড়ো প্রেমের, বড়ো সুন্দরের। আকাশ জুড়ে হলুদ আলো গুলাল খেলে সাঁঝবেলায়, পলাশ পাপড়ি ঘুমিয়ে পড়ে রাত গভীর হলে।
সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা পার ক'রে আজ এই ছিন্নভিন্ন সময়েও রঙ ভ'রে ওঠে কোমল কুসুম প্রাণে। হ্যাঁ, কৃত্রিমতা পার ক'রে অকৃত্রিমতার উৎসবের বাসনায়।আজ উদযাপনের হাত ধ'রে কলরব বেশি, আলোর নেপথ্যে থাকে আঁধারের পরত, তবু, তবু বসন্ত উৎসব বড়ো মধুর। কবিগুরু তাঁর শান্তিনিকেতনকে এই দিন উজ্জ্বল ক'রে তুলতেন মহাসমারোহে। তাঁর দ্বারে জাগ্রত হয়ে থাকত বসন্ত। কলম অনাবিল হয়ে উঠত সৃষ্টিতে। নাটকের সংলাপে মুখর হত বিশ্বভারতীর সন্ধ্যার অঙ্গন। আজও শান্তিনিকেতন মেতে ওঠে বসন্ত উৎসবে। খোয়াইয়ের মনে পড়ে হয়তো, প্রতিবছর,কবিগুরুর কন্ঠে দোল উৎসবের গান, যা এখনও অনুরণিত হয় শিক্ষার্থীদের সুরে। আশা জাগানিয়া হয়ে।
দোল উৎসবের আগের রাতে কাঠকুটোয় আগুন দিয়ে হয় নেড়াপোড়া। হোলিকা ছিল হিরণ্যকশিপুর বোন। আগুন তাকে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছিল। 'অগ্নি তাকে স্পর্শ করতেই পারবে না', এমন বর পেয়েছিল কিন্তু হোলিকা। অহমিকায় পূর্ণ হয়ে সে প্রহ্লাদ কে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অগ্নিকুণ্ডে, হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে। পিতা মৃত্যু চেয়েছিল পুত্রের।আগুনের শুভ শক্তি প্রহ্লাদকে বাঁচিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছিল হোলিকা কে, বরপুত্রী হয়েও সে রেহাই পায় নি। দৈত্য কুলে প্রহ্লাদ জন্মেছিল, সব অশুভের বিনাশ করতে।
আজ যতদূর চোখ যায়, আমার শহরে আকাশ ছোঁয়া সুউচ্চ আলয়। খোপে খোপে বসন্ত দূর থেকে কোকিল ডাকের মতো। একটানা ডাক শুনি, কিন্তু অধরা। আজও কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তায় শিমূল ফোটে। গাছ ভ'রে, রাঙা হয়ে। বসন্তের উৎসবে আজও আবীরে মাখামাখি হয় বসন।আগুন জ্বলে, অশুভ বিনাশের প্রার্থনায়।মনের কোণে তবু শতেক দ্বিধা। আজ বড়ো অশান্ত মুহূর্ত যে। অপেক্ষা করি আমরা শুভ শক্তির। অনন্ত অপেক্ষ করি প্রভাতফেরির , যে প্রভাতফেরিতে অসংখ্য মানুষ একসঙ্গে ডাক দিয়ে দিয়ে যাবে,
'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল/লাগল যে দোল/স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল/খোল দ্বার খোল... '
সব দ্বার খুলে যাবে। সব মানুষ পথে নামবে, নির্ভয়ে। দোল বসন্ত জয়ের উৎসব হবে।