আশির দশকের শেষদিকে আটকে আছে আমাদের প্রজন্মের ক্যাবলা ছেলেবেলাগুলো। আইফোন নেই, সেমিস্টার নেই, কেএফসি নেই.....অথচ কী সহজ, উজ্জ্বল অমলিন সেইসব জীবন। অর্ধেক আয়ু পার করে এসে আজকাল সেইসব বসন্তের কথা মনে পড়ে, কর্পোরেট হোলি নয়,বাংলা দোল উৎসব।সেইসব অনির্বচনীয় সকালে আবীর ছিল,লাল হলুদ সবুজ সস্তা গুঁড়ো রঙ ছিল,মঠ-মুড়কি-ফুটকড়াই ছিল,আর হাওয়ায় হাওয়ায় ছিল একটা হালকা মিঠে সুখ সুখ গন্ধ। মফঃস্বল শহরের অলিতে গলিতে ছিল আত্মীয় বান্ধব,পাড়ায় পাড়ায় উষ্ণ হৃদয়ের আপনজন আর সুখ দুঃখের সাথী।
আমাদের কেউ শিখিয়ে দেয়নি ' হ্যাপি হোলি ' উচ্চারণ, বরং আমরা শিখছিলাম দোলের আগের দিন কে কতো বেশি নারকেল পাতা,শুকনো পাতার রাশ জড়ো করতে পারে পাড়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরে বন-বাদাড়ে সরেজমিন তদন্ত করে। দোলের আগের দিন রাতে ন্যাড়াপোড়ার গাঢ় হলদে আগুনের আলো স্বপ্নময় মৃদু স্মৃতি হয়ে আমৃত্যু থেকে যাবে,কিংবা কচি গলায় সুর করে আবৃত্তি 'আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া কাল আমাদের দোল...'। বসন্তকে আমরা চিনতাম আবীরে, রঙগোলা জলের শৈশবে। একেকটা দিন ছিল পাক্কা শৈশবের দিন,এক্স-ওয়াই-জেড জেনারেশনের থেকে আলোকবর্ষ দূরের একটা সময়ে হতো আমাদের দোল উৎসব, রাস্তায় রাস্তায়, পুরোনো পাড়ার অলিতে গলিতে। ভাই-বোন,বন্ধু-বান্ধব,কাকা,জ্যাঠার গণ্ডিতে,হয়তো খুব বাহারে নয়,গ্ল্যামারসর্বস্ব নয়,তবু প্রাণের খুব কাছাকাছি।
সেদিন ট্রেনে করে ফিরছিলাম মফঃস্বলের সেই ছোট্ট স্টেশন থেকে, এখন সেই স্টেশনের পাশে শপিং মল, কাছেই তৈরি হচ্ছে নতুন টাউনশিপ, শহরের অলিতে গলিতে বহুতল আর বহুতল, সেসবের আড়ালে কোথায় চাপা পড়ে গেছে আমার শৈশবের পাড়া,দোল-উৎসব আর বসন্ত.....
ট্রেনে একজন অন্ধ মানুষ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছিলেন "আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে গেছে বনে", আমি ঐ ভরদুপুরে চোখ বুজে ফেললাম,ঐতো পাশের বাড়ির ছোট ছেলেটা কমদামী পিচকারি নিয়ে হাসিমুখে উঁকি দিচ্ছে,গায়ে আলনার সবচেয়ে ছেঁড়া -পুরোনো জামা প্যান্ট। ঐতো পাড়ার দাদা আবীরের প্যাকেট নিয়ে প্রত্যেক বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বড়োদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করছে,ঐতো পিছুটান টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের 'বসন্ত এক্সপ্রেস '।