নিজের মাটির শিল্প-সংস্কৃতি-ভাষা বাঁচানোর দায় নিজের

বাংলা ভাষা সংকটে,সংকটে বাঙালি। বাংলা ভাষার গায়ে জ্বলছে তিন নম্বর বিপদ সংকেত, শিগগিরই বোধহয় ডুবল বাঙালি। এমন কথা মুড়ি মুড়কির মতো উড়ে বেড়ায় হাওয়ায় প্রায়ই। বিশেষত পয়লা বৈশাখে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে বাড়াবাড়িটা কিঞ্চিৎ বাড়ে। এখন প্রশ্ন হল পৃথিবীর কোন ভাষা সবচেয়ে নিরাপদ? কোন জাতি জোর গলায় বলতে পারে যে আগামী পাঁচশো বছর টিঁকে যাবে? ইংরেজি? হিন্দি? বোধহয় না। অনুপ্রবেশ সব ভাষার,সব সংস্কৃতির বিশুদ্ধতাই টলিয়ে দিচ্ছে। সব ভাষাই আসলে আজকাল সংকটে,সব জাতিই বিশ্বায়নের ফাঁদে পড়ে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থায়। মানে কেউ জেনারেল বেডে তো কেউ আই সি ইউ তে, তফাৎ শুধু এটুকুই। আজ থেকে পাঁচশো কী এক হাজার বছর পর মানুষ যে কোনো ভাষা ভুলে গিয়ে শুধু কিছু কোড ল্যাঙ্গুয়েজ এ কথা বলবে না,তার নিশ্চয়তা কোথায়? ভাষাগত জাতি পরিচয় যে বিলুপ্ত হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। অবশ্য সংকেতও তো এক ধরনের ভাষা।

মাতৃভাষা না হলেও মাদারবোর্ড-প্রসেসর প্রসূত ভাষা তো বটেই। তাই ভাষা ও জাতি সঙ্কটে ভেবে একধরনের বিপন্নতামূলক সংবেদন অনুভব করেন কেউ কেউ, আত্মবিস্মৃত জাতির কোনো প্রতিনিধির মুখের সামনে স-ক্যামেরা মাইক্রোফোন ধরে বাংলা সাল জিজ্ঞেস করে আত্মশ্লাঘা বোধ করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দীর্ঘ দীর্ঘ প্রবন্ধ জমা হয়। অভিযোগের পর অভিযোগ,প্রশ্নের পর প্রশ্ন। উত্তর নেই, সমাধান নেই। কিন্তু 'অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?' অতএব একাডেমিক কুম্ভীরাশ্রু চলে একখাতে,বাংলার ভাষা-সংস্কৃতি বয়ে চলে আরেক খাতে। আমরা দোষারোপের  টকশো চালাই ঘন্টার পর ঘন্টা,তবু দিনে আধঘন্টা ভাষাচর্চা করিনা। আজ থেকে বছর পঁচিশ- ত্রিশ আগে সন্ধ্যায় বাঙালি পাড়া দিয়ে গেলে শোনা যেতো শাঁখের আওয়াজ, কোনো ঘর থেকে ভেসে আসতো হারমোনিয়াম,তবলা,গানের শব্দ কিংবা সেতারের টুং টাং। তাঁরা কেউ পেশাদার গাইয়ে বাজিয়ে ছিলেন না, ছিলেন অ্যামেচার চর্চাকারী,সংস্কৃতির নীরব ধারক। দেখতে দেখতে এঁরা যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন, কোন দিকশূণ্যপুরের পথে বিলীন হয়ে গেলেন কালের স্রোতে। এখন পঁচিশে বৈশাখ সন্ধ্যায় বেরোবেন তো পথে, খুঁজে দেখবেন কটা রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব দেখতে পান। প্রশ্ন হলো ক্ষত যে তৈরি হচ্ছে তা সবাই মানছি, কিন্তু মলম লাগাচ্ছি না, একদিন যে এই ছোট ছোট ক্ষতই দগদগে ঘা হয়ে দাঁড়াবে,তা আমরা দেখেও দেখছি না,বুঝেও বুঝছি না। আমরাই তো পারি খুব ছোট্ট ছোট্ট করে ঘরে বসে সংস্কৃতির চর্চা করতে। তাতে আড়ম্বর লাগেনা, অর্থ লাগেনা, শুধু দরকার একটুখানি ইচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম লাইভ করে দুনিয়াকে দেখানোর দরকার নেই। বিশ্বায়নের এই বাজারে মায়ের সংস্কৃতি নাইবা বেচলাম, আর সবই তো বেচে দেউলিয়া হয়ে গেছি আমরা,নিজের বলতে এটুকুই থাক। শুদ্ধ নিজের ভাষা, নিজের শিল্প, নিজের সঙ্গীত, সাহিত্য, নিজের সংস্কৃতিকে একটুখানি সময় দিই। তাতেই সব হবে,সময় লাগবে,তবে একদিন ঠিক হবে। বাংলাভাষা দুনিয়া জয় করবে। সেদিন নিজেদের পিঠ নিজেদেরই চাপড়ে দেওয়ার আর দরকার পড়বে না। ও করলো না,এ কিছু করছে না...এই ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ির সংস্কৃতি থেকে একটু বেরিয়ে আসুন, আয়নার দিকে তাকান। দেখুন ওখানে একজন অপেক্ষা করে আছে কিছু করার জন্য।ঐ লোকটাকে গুরুত্ব দিন,ওকে কিছু করতে দিন ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য। আত্ম অপমান করতে করতে

আমাদের স্বজাত্যবোধ তলানিতে এসে ঠেকেছে, একবার ভাবুন আপনার মায়ের ভাষা, নিজের শিল্প সংস্কৃতি বাঁচানোর দায় আপনার পড়শির নয়,একান্তই আপনার। আপনিই যদি নিজের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করেন,থুতু ছোঁড়েন, অপরে তো পায়ে পিষে যাবেই। ময়ূরপুচ্ছ আপনার দুনিয়াকে দুদিন রঙিন করলেও, মনে রাখতে হবে আড়ালে তার সূর্য হাসে। নিজের ঘরের মণিমাণিক্যয় শ্যাওলা জমে উঠলো, প্রতিদিন একটু একটু করে ঘষামাজা করুন, একদিন দেখবেন আপনার ঘরের বৈদূর্যমণি সকলের চোখ ঝলসে দিচ্ছে। বাঙালির এই ঐশ্বর্যর ভয়েই ধনতন্ত্র প্রতিদিন হাজার লোভের ঠেলাগাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করে আপনার চোখের সামনে, প্রতিদিন এই বোধের ইঞ্জেকশন দেয় যে আপনার ভাষা, সংস্কৃতি হীন, মৃতপ্রায়,চলতি বাজারে মূল্যহীন। এই বিষের ট্যাবলেট খেয়ে আপনি অমর হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন কিনা,তা একান্তই আপনার পছন্দের বিষয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...