দিদা বলেছিল , বড় হয়ে ওসব ছেলেখেলা আর করতে নেই!

সুস্মিতা বিশ্বাস, আগরপাড়া

সেসময়, আমাদের বাচ্চা পার্টির কাছে বিশ্বাস জ‍্যাঠাইমা ডাকসাইটে বিখ্যাত ছিলেন। মাটির তৈরি বর-বউ, তাদের বাচ্চা, কুকুর-বিড়াল-ঘোড়া যার যেমন 'requirement' বিশ্বাস জ‍্যাঠাইমাকে বললেই হত । শুধু তাই নয়, সেলাই করা জামা, শাড়ি, গয়না কত্তকিছু, সেসব তো আমরাও ভেবে উঠতে পারতাম না।
তারপর, তাদের তোশক, বালিশ, বিছানা যেন আলাদিনের জিনির মত হাজির করে দিত সব । সেই রং-বেরঙের পুতুলখেলা দিয়েই রামধনু হয়েছিল আমাদের ছোটবেলার দিনগুলো।
এক বছর দিদা রথের মেলায় ঘুরতে নিয়ে গেছিল।
সেকি মজা, মেলা থেকে দিদা এক প্যাকেট খেলনাবাটি কিনে দিল। তাতে প্লাস্টিকের সবুজ হাঁড়ি, লাল কড়াই, হলুদ উনোন, নীল খুন্তি, কি ছিল না!

pu-1
সেসব পেয়ে উৎসব শুরু হয়ে গেল আমাদের । সেবার পুতুলের বিয়ে দিলাম আমরা। আমি, পাশের বাড়ির মুনা, পিকাই, ওর ছোটবোন পিলু, সবাই মিলে। দুজন কন্যাযাত্রী, দুজন বরযাত্রী । যে পক্ষ কন্যাযাত্রী তাদের প্রথম দিন কাজের অনেক চাপ ।
সাদা ফুলের কুড়ি দিয়ে ভাত, সজনে গাছের পাতার শাক, ঝরে পড়া এঁচোড় দিয়ে গাছ পাঁঠার মাংস, আমের গুটির টক।
সেসব জোগাড় করে রান্না করা কি চাট্টিখানি কাজ!
একবেলায় পেরে ওঠা যেত না। সকালে জোগাড় করে রান্না হলেও; মায়েদের, আমাদের করা রান্নার ওপরে বিন্দুমাত্র আস্থা না থাকায় , ঘরে তাদের রান্না খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পারিয়ে, দুপুরের অতি ব্যস্ত সময়ে বিশ্রাম করে বিকালে খেলতে দেবে, সেই ভরসা দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন অন্দরে। আমরা অবশ্য খুব একটা মনক্ষুন্ন হতাম না , কারণ আসল বিয়ে তো সন্ধ্যে বেলাতেই হয়। তাই বিকেলে আবার খেলা হবে ভাবতে ভাবতে, একসময় পুতুল খেলার ঘরেই রঙিন স্বপ্ন খুঁজে নিতাম ।

pu-2
তবে বরযাত্রী আসা অবধি আমাদের খেলা দুদিন ধরে একই ভাবে চলত বলে মনে হয় না। কোনদিন পিকাই মুনাকে দিল এক কিল বসিয়ে, ব্যস কাঁদতে-কাঁদতে উল্টে গেল হাড়ি, শুরু হল মারামারি ।
কোনদিন পিলুকে কাঠ-পিঁপড়ে কামড়ে দিল , সেই চিৎকার শুনে পিলুর মা কাকিমা, কী হয়েছে কী হয়েছে করতে করতে দৌড়ে এসে পিলুকে কোলে নিল, আর বোনকে দেখে রাখতে পারেনা বলে পিকাইকে দুচার-ঘা দিয়ে বাড়ি নিয়ে গেল টানতে টানতে।
সেসব খেলা ভাঙার কারণ এমনি এমনি হত, আবার এমনি এমনি হারিয়ে যেতে স্মৃতি থেকে। তাই পরদিন আমরা আবার নতুন খেলা শুরু করতে পারতাম। ছোট ছিলাম তো।
তারপর কবে বিশ্বাস জ‍্যাঠাইমা বুড়ো হয়ে গেল, কবে পিকাই বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আসল ঘর-সংসার করতে শুরু করল, সেসবের দিন তারিখ থাকলেও, ঠিক কবে থেকে আমরা পুতুল খেলতে ভুলে গেছি তা আজ আর মনে পড়ে না।

pu-3
মনে আছে অনেকদিন পরে একবার দিদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেই পুতুল, খেলানাবাটি, ওদের জামা, গয়না, বিছানা কই গেল!
দিদা বলেছিল, বড় হয়ে ওসব ছেলেখেলা আর করতে নেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...