প্রতিভা সরকার, সল্টলেক
রেললাইনের ধারে তখন বেদিয়ারা ঝোপড়ি বেঁধেছে। ন্যাংটো বাচ্চাগুলো কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে খেলছে। ছেলেরা কেউ শুয়োর চরাচ্ছে, কেউ বাঁশের কঞ্চি ছাড়াচ্ছে। এক মহিলা, তার বিনুনিতে অনেক পুঁতি সাজানো, এইটুকুই মনে আছে এতদিন পর, আমাকে দেখে এগিয়ে এল।
- কাঁহা যাওগে বাবুয়া!
আমি তো তোতলাচ্ছি। সে তাঁবু থেকে তার মরদকে ডেকে নিয়ে এসে অনেকক্ষণ নিজেদের ভাষায় কী বলাবলি করলে। ওদের কালো একটা ছাগলছানা এসে আমাকে অনেকক্ষণ শুঁকলো, তারপর সামনের দুই পা তুলে তুলে খেলা করতে লাগল। আমার দিব্যি লাগছিল। এখানে কেউ ‘পড়তে বস’ বলে মাথা খায় না, খেলাধুলার ওপর ট্যাক্স নেই, শুধু একটু খিদে পেয়ে গেছিল। সেই সকাল থেকে খাওয়া নেই তো। সেটা বুঝেই বেণিতে পুঁতি সাজানো মেয়েটা একটু গন্ধওয়ালা রুটি আর আচার এনে দিল। সে আচার কী ঝাল, কী ঝাল, বাপ রে, তবু খিদের মুখে যেন অমৃত!
খাওয়া হলে তারা স্বামী স্ত্রী মিলে চলল আমাকে ফেরত দিতে। কাঁধে ঝোলা ছিল কিনা মনে নেই, হাতে বাঁকানো লাঠি ছিল, সাপ-খেলানো লাঠি। পথ দেখিয়ে নিজের পাড়ায় এসে ঢুকেছি কী না ঢুকেছি, দেখি বিশাল জমায়েত, তুমুল হল্লা, সরকার বাড়ির মেয়ে হারিয়েছে।
আমাদের দেখেই পালে পালে লোক লাঠিসোঁটা হাতে রে রে করে ছুটে এল। ধারণা বাদিয়ারাই আমায় ধরে নিয়ে গেছিল। আমার কচি গলার কান্না ওদের কানে পৌঁছলে তো!
তারই মাঝখানে পিসি এসে আমার হাত ধরে টেনে বাড়িতে ঢুকিয়ে নিল। আমি আকুল হয়ে কেঁদে যতই বলি, ওরা ভালো, ওদের মেরো না, বড়রা ততোই চোখ পাকিয়ে বলে, চোওওপ। একটিও কথা নয়। কোথায় তোকে চালান করে দিত, তুই জানিস?
পরে শুনেছিলাম ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই থেকেই ভিড়কে আমার সারা জীবনের ঘেন্না। আর স্বপ্ন শুধু রেল লাইনের ধার তাঁবু খাটিয়ে স্বাধীন জীবনের স্বাদ পাওয়া।
এমনই দুর্ভাগ্য, সর্বত্র ভিড়ের একজন হয়ে থাকতে হল, আর রেললাইনের ধার? ভাবলে নিজেরই হাসি পায়!