ওই ছেলেধরা আসছে শুনলেই আমরা চুপ!

 

প্রতিভা সরকার, সল্টলেক

 

আমাদের ছোটবেলায় প্রভাতফেরি হতো। সাদা কেডস, সাদা জামায় লাইন করে গোটা এলাকায় ঘোরা হত গান গাইতে গাইতে। তখন ‘ওরে নতুন যুগের ভোরে’- গানটা ছিল প্রভাত ফেরিওয়ালাদের হাতে- গরম প্রিয়, মানে হট ফেভারিট।

 

আর ছিল ছেলেধরা। বাপরে তাদের কী প্রভাব প্রতিপত্তি। ওই ছেলেধরা আসছে শুনলে আমরা ক্লাস এইট অব্দি চুপ করে গেছি। এখনকার শহুরে বাচ্চারা ছেলেধরার নামও শোনেনি। জানেই না বিরাট ঝোলা নিয়ে অচেনা মুখ এলাকায় দেখা গেলেই তাকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করা হতো। এখন যে নব রূপে ছেলেধরার আবির্ভাব হয়েছে তা হল কিডন্যাপার। তার যেমন বোলচাল, তেমনি ভয়ংকর চাহিদা। পঞ্চাশ লাখের কম মুক্তিপণ চায় না। না পেলে বাচ্চাটাকে মেরে পুঁতে দেয়।

 

আমাদের ছেলেধরা এতো কঠিন-হৃদয় ছিল না। প্রথমত নিশ্চয়ই সে পড়াশোনা জানত না। ছেলেধরা কাউকে চিঠি দিয়ে মুক্তিপণ চেয়েছে এমনটা শোনা যেতো না কেন তাহলে। ছেলেধরা নিয়ে গেছে মানে জন্মের যাওয়া এরকমই ধরে নেওয়া হতো। দ্বিতীয়ত বাচ্চা ছেড়ে দিলে সে এমনই দিতো, টাকা নিয়ে নয়, আর না দিলে একেবারে খোঁড়া কী অন্ধ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামিয়ে দিত। ছেলেধরা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ছিল মোটামুটি এইরকম।

একবার প্রভাতফেরি আর ছেলেধরা দুইই এসে আমার জীবনে দেখা দিয়েছিল। বলি তাহলে সে গল্পটা।

 

পঁচিশে বৈশাখের প্রভাতফেরি।  মাঠ থেকে বন্ধুদের কলকাকলি শোনা যাচ্ছে। মা আমার কেডসের ফিতে বাঁধতে কেবলই দেরি করছে। অধৈর্য হয়ে আমি বললাম, ওখানেই বেঁধে নেব, ছাড়ো তো এইবার।

মা চ্যাঁচ্যাঁতে লাগলো, ওরে পায়ে বেঁধে পড়ে যাবি, ব্যথা পাবি।

কে শোনে কার কথা। সাঁ করে বুলেটের মতো বেরিয়ে যাচ্ছি কানে এলো বাবার গম্ভীর গলা, কে যায়, কে যায়!

 

এই একটা লোককে ডরাতুম যেন ছেলেধরার থেকেও বেশি। যেন সাক্ষাৎ যম। তার গলা শুনে এক মূহুর্ত থমকালাম বটে, কিন্তু বন্ধুদের টান! এমনই টান, আমি ভদ্রলোকের মারের ভয়ও কাটিয়ে দিলুম। যা থাকে কপালে!

কিন্তু প্রভাতফেরি শুরু হবার আগেই বুঝতে পারলাম কাজটা ভালো করিনি। বোন প্রভাতফেরির জন্য নিখুঁত সেজে লাইনে দাঁড়িয়ে বলল, দিদি, বাবা তোকে ডাকছে।

 

বাবা ডাকছে মানে হাতে লাঠি নিয়েই ডাকছে। বা বাঁশের কঞ্চি। ওগুলোতে মারলে বড় লাগে। কিন্তু আমাদের সময়ের বাবারা কথা না শোনাকে এতো বড় অপরাধ ভাবতো যে অবাধ্যতা ভূত নামাতে ওঝার পিটুনি ছাড়া আর কিছুই জানতো না। কাউন্সেলিং-ফাউন্সেলিং শব্দগুলোর তখনও জন্মই হয়নি।

 

আমি দেখলাম, বাড়ি গেলে এখন উদোম পিট্টি খেতে হবে। প্রভাতফেরিই করে যাব, সে উপায়ও নেই, বাবা তাহলে নিজে এসে চুল ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে যাবে। আমি বাড়ির গেটে না ঢুকে যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চললাম। ছোট মেয়ে, হাতে স্কুল ব্যাগও নেই, দিনটা আবার পঁচিশে বৈশাখ, অনেকে সন্দেহের বশে তাকিয়েছিল, কিন্তু কিছু বলেনি। আমি সেই সুযোগে সোজা রেললাইনের দিকে। কোথায় যাব জানি না। কিন্তু কোথাও তো যেতেই হবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...